জামানা হাসিনা জাফরান :
যেকোনো জাতিরই তার মাতৃভাষার প্রতি থাকে গভীর টান। বাঙালির কি তা হবার নয়? বিশ্বের ইতিহাসে একমাত্র বাঙালিরই মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জনের ইতিহাস আছে, আছে স্বর্ণখচিত দলিল। নাম তার একুশ। একুশই বাতিঘর হয়ে বাঙালিকে একটি বেদনা বিজড়িত প্রদীপ ধরে দেখিয়েছিল তাদের জাতিসত্তার ফটকদ্বার উন্মোচনের আঁধার পথ। তাই বাঙালি জাতি মাত্রই তাদের চেতনায় প্রোথিত হয়ে আছে একুশের মর্মার্থ। একুশ দিয়ে বাঙালি জাতি প্রমাণ করেছে তাদের প্রাণের ভাষা বাংলাই পারে সাম্প্রদায়িকতা তথা দ্বিজাতিতত্ত্বকে মিথ্যা রূপ দিয়ে মানবতাকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে। একুশ প্রতিবছর ফিরে ফিরে আসে গোটা বাঙালি জাতিকে আবার শাণিত ও উদ্বুদ্ধ করতে। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত।
প্রসঙ্গত, কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে বসবাসরত দুই বাঙালি জনাব রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম উদ্যোগ নিয়ে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবটি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর প্যারিস অধিবেশনে উত্থাপন করা হয়। অতঃপর অফিশিয়াল বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে প্রস্তাবটি বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে সমর্থন চেয়ে ইউনেসকোর কাছে প্রেরণ করা হয়। এর ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাবটিকে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানায়। সেই থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথার্থ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।
এখন বিশ্বায়নের দিন। বাঙালিও এখন বিশ্বজয়ের নেশায় বিভোর। তাই বিশ্বের যেকোনো আনাচ-কানাচে গেলেই আপনি বাংলার সন্তানসন্ততি দেখতেই পাবেন। এটা অবশ্যই গৌরবের। অন্যদিকে আমাদের জাতিগত মৌলিক সত্তা অর্থাৎ যে ভাষা আন্দোলন, যে শহীদদের রক্ত এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে বিশ্বাঙ্গনজুড়ে বসেছে, সেই মহান গৌরব কি তবে হাজার রকমারি ভিন ভাষা আর ইংরেজি ভাষাসমুদ্রের প্লাবন অতলে ডুবে যাবে? এই প্রশ্নটা কিন্তু এখন নড়েচড়েই বসেছে। যদিও আমরা অনেকে এখনো এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। জানি না, তবে কি আমরা বাংলা ভাষাকে সম্মানের সঙ্গে ভালোবেসে গ্রহণ করতে পারছি না? কোনো গৌরব অর্জন করা যতটুকু কঠিন, তার চেয়েও কঠিন তা রক্ষা করা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই শিক্ষাবিদদের মহল থেকে বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হওয়ার কথা উঠেছিল। কিন্তু আজও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। দুঃখের বিষয়, এখনো বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ব্যবস্থাপনায় ইংরেজির ব্যবহার চালু রয়েছে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব সফরের যেকোনো সম্মেলনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। তিনি বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সাধুবাদ জানাই তাকে।
এ কথা সত্য, যুগের পর্যায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে গেলে বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার তথা যোগাযোগমাধ্যমগুলোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তাই বলে ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের নিজস্ব সত্তা যেন বিসর্জিত না হয়। অন্তত শিক্ষিত বিদগ্ধজন যেন এ বিষয়ে পরিচর্যাকারী হয়ে ওঠেন। কেননা এখন ভাষা বিকৃতির হিড়িক পড়েছে। বিশেষ করে, এফএম রেডিওর বিরুদ্ধে ভাষা বিকৃতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। বাংলা নাটকেও এখন মাঝে মাঝে বিদেশি গানের সংযোজনের উদাহরণ মেলে। হিন্দি সিনেমার তুমুল ধকল ও ভিন দেশি সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের কোমলমতি শিশুদের দিন দিন পরদেশি জগাখিচুড়ি পথে পরিচালিত করছে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিশৃঙ্খল হওয়ায় নেতারা বারবার নিজেদের অনুকূলে বিকৃত ইতিহাস রচনা করে ইতিহাসের পথকেও বিপথগামী করেছেন। ইংলিশ স্কুলগুলোয়ও বাংলা ততটা গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় না।
এদিকে প্রবাসে বসবাসরত বাঙালি প্রজন্মের দিকে তাকালে যে ছবি ভেসে ওঠে, তা সত্যিই ভাবিয়ে তোলে। প্রবাসী অভিভাবকদের কথা বলছি, আমরা নিজেরা বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা আমাদের সন্তানসন্ততির সঙ্গে গৌরব ও প্রহ্লাদের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় বাক্য বিনিময় করি। অন্য বাঙালি বন্ধুর দেখা পেলে যেন আরো বেশি সরবে ভুল উচ্চারণ করে হলেও ইংরেজি ভাষায় মেতে উঠি। এতে যেন আমরা উঁচু জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার সুখানুভূতিতে ভুগি। এমনিতেই বিদেশে চলার প্রধান বাহন ইংরেজি ভাষা হওয়াতে আমাদের প্রজন্ম বাংলা ভাষা চর্চা করার সুযোগ কম পাচ্ছে। তা ছাড়া বিয়ের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম যার যে ভাষায় ইচ্ছা সে ভাষাভাষী জীবনসাথিকে বেছে নেওয়ার কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তো বাংলা ভাষায় কথা বলা প্রশ্নাতীত হবে। তার ওপর আমাদের বর্তমান বাঙালি অভিভাবকদের এহেন উঁচু সম্প্রদায় বনে যাওয়ার মানসিক অসুস্থতার পীড়নের চাপে পড়ে আমাদের জাতীয় সত্তা, আমাদের গৌরবান্বিত মৌলিক সম্পদ আমাদের মাতৃভাষা হুমকির সম্মুখে পড়েছে। যে ভাষার জন্য বাঙালি আত্মোৎসর্গের নজির তৈরি করেছিল, সেই ভাষার গৌরবকে আমরা ধরে রাখতে চাই নাকি অবহেলায় পথের ধুলোয় ফেলে রাখতে চাই? মাতৃভাষার জন্য জীবনদানকারী একটি জাতির মাতৃভাষার প্রতি এহেন অবহেলা খুবই দুঃখজনক।
যদিও আমরা জানি, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীর জনসংখ্যা ২৮ কোটি ৫০ লাখ। মাতৃভাষা হিসেবে পৃথিবীতে বাংলা ভাষার স্থান পঞ্চম এবং গোটা বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত ভাষা অনুযায়ী বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। তদুপরি ইউনেসকোর জরিপে একুশের আদর্শে অর্জিত আমাদের বাংলা ভাষা বিশ্বের মধুরতম ভাষারও স্বীকৃতি পেয়েছে।
প্রবাসে আমাদের ভাষা বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখে দাঁড়িয়েও কেউ কেউ থেমে নেই। কোনো কোনো শিক্ষক বাংলা স্কুলসহ সংগীতায়ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে বাংলা ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন করার চেষ্টা করছেন। আবার কোনো কোনো সংগঠন বাঙালির বিভিন্ন উৎসবের দিন, যেমন পহেলা বৈশাখ, বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস, পূজা-পার্বণ, পিঠা উৎসবের আয়োজন করে, বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে নতুন প্রজন্মকে নিজ দেশ, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কিছুটা বাঙালিয়ানা চর্চা হলেও তা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন আরো বিস্তৃত রূপে, আরো সম্প্রসারিত পথে বাঙালিয়ানা চর্চা এগিয়ে নেওয়া। বাঙালি-অধ্যুষিত প্রতিটি এলাকায় বাংলা স্কুল পরিচালিত করা, বিদেশের স্কুল-কলেজগুলোতে বাংলা বিভাগ চালু করা জরুরি বলে ভাবছি। সকল শ্রেণির প্রবাসবাসী বাঙালিদের এ বিষয়ে সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে উদ্যোগ নিয়ে জোরেশোরে এগিয়ে আসা জরুরি বলে ভাবছি। সেই সঙ্গে বাঙালির ঘরে যেন আমাদের বাচ্চারা অবশ্যই বাংলা ভাষায় কথা বলে, সেই খেয়াল রাখা জরুরি। প্রয়োজন আরো বিপুল আকারে বাংলা ভাষা চর্চা, শুদ্ধ বানান এবং প্রমিত উচ্চারণ চর্চা করা। লেখায়, বলায়, পঠনে, পাঠনে সর্বস্তরে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা চাই। বিদেশে কিছু অনিয়মিত বাংলা স্কুল চালু হয়ে আবার থেমে যায়। প্রজন্মরা অবুঝ, জীবনের দাবি সময়মতো বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু প্রজন্মের নৈসর্গিক অধিকারের দাবির প্রয়োজনে আরো দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে ওই স্কুলগুলোকে নিয়মিত চালু রাখা।
ইতিমধ্যে আমরা আমাদের বর্তমান বসবাসস্থলে বাংলাদেশ কানাডিয়ান ক্যালগেরি অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বাঙালি শিশুদের বাংলা শিক্ষা দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবে বাঙালি-অধ্যুষিত প্রতিটি এলাকায় বাংলা স্কুল চালু করলে এবং পরিচালিত করে গেলে আশা করি আমাদের গৌরবান্বিত বাংলা ভাষাকে বিলুপ্তির অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে দিতে হবে না। আমাদেরকে তৃণমূল পর্যায় থেকে বাংলা ভাষা, বাংলা কৃষ্টি ও সংস্কৃতি শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। প্রবাসে বাঙালির জাতীয় সত্তা ধরে রাখতে হলে বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি দিনেই নয়, পুরো বছরই বাংলা ভাষা চর্চা ও বাঙালিয়ানায় জোর দিতে হবে।
আমাদের ভাষা আন্দোলন আসলে থেমে নেই, অর্থাৎ ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য, আমাদের জাতীয় সত্তার অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। তাই একুশের আদর্শে অর্জিত গৌরবকে নিয়েই আমাদের আরো দূর এগিয়ে যেতে হবে। সে জন্য আমাদের বাঙালি অভিভাবকদের সদিচ্ছার হাতই হবে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। রক্ত বিক্রি করে কিনেছি বাংলা, কারো দান-খয়রাতে নয়।
-ক্যালগেরি, কানাডা