মনজুরুল সরকার দুলাল :
‘আমি হলফ করে বলতে পারি, ওরা স্বর্গে গেলে এসবই করবে।’
আমি বক্তাকে বুঝতে চেষ্টা করি। ধরতে চেষ্টা করি, তার মনের মাঝে কোন রস খেলা করছে? একগাদা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারে।
প্রথমেই হলফ করার কী আছে? সবটা শোনার পর বিপক্ষে মত দিলে তবেই হলফের কথা আসতে পারে। নিশ্চয় খারাপ কিছু করবে, নাহলে এ কথা আসতই না। কিন্তু কোন ধরনের খারাপ কাজ করবে এবং কেন করবে? সাধারণত লাভ ছাড়া তো কেউ কিছু করে না। তবে স্বভাব দোষে মানুষ অনেক কিছু করে। কারা করবে? এই বিষয়টা জানলেই কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে।
হঠাৎ মগজের কলকবজাগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে। ছোটাছুটি বলতে পারেন। জট পাকিয়ে যাবে না তো? নিজেকে হালকা হালকা লাগে। মনে হচ্ছে, এখনই পৃথিবী ঘুরতে শুরু করবে। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করি। নিজেকে বলি, ‘মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।’ ধীরে ধীরে চেয়ারে বসি। চোখ লেগে আসে।
দেখি, আমি কাচের প্রাচীরঘেরা এক দেয়ালের বাইরে। ভেতরে তাকিয়ে আমার চোখ চড়কগাছ। মা গো মা, কত যে সুন্দর বাগান। নানান রঙের ফুল ও ফলের গাছ। পাখি আর কাঠবিড়ালি আনন্দে খেলাধুলা করছে। অনুমান করি, দেয়ালের ওপাশে সুগন্ধে ম-ম করছে। ফলগুলোর রং ও টসটসে রূপ দেখে জিবে জল এসে যায়। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তবু মন মানে না। ভেতরে যেতে মন আনচান করে। ঘুরে ঘুরে গেট খুঁজি। না নেই। অন্তত আমার চোখে পড়ছে না। কোন জাদু-মন্ত্রবলে কাচের দেয়ালের শরীরে গেট মিশে থাকতে পারে। অসাবধানতাবশত কাচের দেয়ালে হাত লেগে যায়। চোখের পলকের মধ্যে এক অপরূপ রূপসী দেয়ালের ওপারে, আমার সামনাসামনি দাঁড়ায়ে।
: বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
: গেট খুঁজে পাই না।
: আছে, প্রয়োজনে আমরা ব্যবহার করি। কিছু বলবেন?
: দূর থেকে কথা বলতে উসখুস লাগে, ওপাশে গিয়ে বলি?
: আমি খুবই দুঃখিত। এটা স্বর্গের বাগান : ‘নন্দন কানন’। এখানে আসতে হলে আগে মারা যেতে হবে।
: এসব কী বলেন? আপনার মুখে দেখি কিছুই আটকায় না।
এই প্রথম আমি রূপসীর ভাবগতি বোঝার চেষ্টা করি। হুরের মতো সুন্দরী। তবে ভাবলেশহীন। চোখে-মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। নাকি আমি ধরতে পারছি না? ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলি। আলতো করে মুছে নিয়ে, আবার দেখি। না নেই। কোনো চিহ্ন নেই। স্বর্গের এই ভাবলেশহীন হুর দিয়ে কী হবে? অকারণে মনটা খারাপ হয়। একটা কাঠবিড়ালি দূর থেকে লাফাতে লাফাতে এসে অভিবাদন জানায়। মনটা স্বাভাবিক হয়। ভুল বললাম, আনন্দে নেচে ওঠে। সবকিছু রূপসীর কাছে ঢাকতে তড়িঘড়ি করে বলি।
: তাহলে ওপাশে যেতে পারছি না?
: না। আমার হাত-পা বাঁধা, নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নাই।
: ও আচ্ছা, আচ্ছা।
: তা ছাড়া আমরা দূরে নই, মাঝে শুধু একটা দেয়াল। ওখান থেকেই বলেন, আমি আপনাকে শুনতে পারছি।
বাচ্য হারিয়ে যায়। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যে আমি বাকপটু, সে কিনা চায়ের কাপে মুখ থুবড়ে পড়ল। এমন অবস্থায় প্রশংসা করা ছাড়া কোনো পথ নেই।
: আপনাকে ঠিক হুরের মতো লাগছে।
: ধন্যবাদ। আপনার আন্দাজ যথার্থ।
: আপনার সাথে কথা বলতে পেরে মনটা আনন্দে ভরে গেল।
: আমারও ভালো লাগছে। পৃথিবীর মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ হলো।
: একদিন বেড়াতে আসেন, আপনার ভালো লাগবে। তবে আগেই বলে রাখি, এখানে ঠাসাঠাসি মানুষ, আর গরম একটু বেশি। তবে ভয়ের কিছু নাই, গাছের ছায়ায় দখিনা বাতাসে মন ভরে যাবে। দেখবেন পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গের অনুভূতির সাথে আমাদের কেমন মাখামাখি। আমরা একে অন্যের সুখে-দুঃখে হাসি, কাঁদি।
কথাগুলো রূপসীর মনে হয় ভালো লাগল না। আমাকে আর বলতে না দিয়ে প্রশ্ন করে বসে।
: আচ্ছা, ওখানে খাবারের কি কোনো অভাব আছে?
: তা আপনি এ প্রশ্ন কেন করলেন? কেউ কি কোনো গিবত করেছে আমাদের নামে?
: না কেউ কিছু বলেনি। এটা আমার পর্যবেক্ষণ বলতে পারেন। ওখান থেকে যারা এখানে আসে, সবাই কিছুদিন গোগ্রাসে খাবার গেলে। যা দেবেন তা-ই গোগ্রাসে গিলে খায়।
লজ্জায় আমার মাথা নত হয়। আসমানেও মানুষের দুর্নাম, এটা কি সহ্য করা যায়? মনে হয় একটা একটা করে মাথার চুল ছিঁড়ি। যা-ই হোক, মানুষের লজ্জা ঢাকতে ওকে কী বলা যায় ভাবতে থাকি। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো একটা বুদ্ধি মাথায় খেলে। বলার জন্য মাথা তুলি।
দেখি আমি টাইম স্কয়ারে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে শরীরে রং করা এক নিরাভরণ মেয়ে। আমেরিকার ব্যক্তিস্বাধীনতার সৌন্দর্য। পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে, আপনি আমি কোনো এক পক্ষে। তাকে সম্মান জানাতে আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার অভিনয় করি। তারপর পাঁচ ডলার হাতে দিই। সে ধন্যবাদ জানিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। লক্ষ করি, আবু তাহের নিবিড় মনে কফি পান করছে। তার দৃষ্টি জনতার পায়ে পায়ে। আমি কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে ঘটনাক্রম সরলরেখায় সাজাতে থাকি।
পড়ন্ত বিকেল। নিউইয়র্কের চোখ-ধাঁধানো স্থান টাইম স্কয়ার। নিজ নিজ কফি হাতে আমরা ম্যাকডোনাল্ড থেকে বের হই। মানুষের ঢল আর ছোটাছুটি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে দুজন বসার মতো একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে বসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সামনে দাঁড়িয়েছি মাত্র। আবু তাহের তখনই হুট করে বলে, ‘আমি হলফ করে বলতে পারি, ওরা স্বর্গে গেলেও এসবই করবে।’
আবু তাহের এবং আবু তাহের আমার বন্ধু। তারা একই ব্যক্তি, শুধু মনের রং ভিন্ন। কলেজে ভর্তি হয়ে এক আবু তাহেরের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এক ক্লাসে পড়ি। একসাথে চা পান করি। একসাথে ভলিবল খেলি। গলায় গলায় ভাব বলতে পারেন। আবু তাহের সিনেমার গল্প বলে। নায়ক-নায়িকার অভিনয়ের পছন্দের অংশটুকু বলে। ক্লাসে পলির সাথে কতবার দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে, তা বলে। আমি শুনি, শুনতে শুনতে শ্রোতা হয়ে উঠি। টগবগ করা অনুভূতির সেই দিনগুলো মগজে গেঁথে যায়, স্মৃতি হয়ে ওঠে। সুখের স্মৃতি, দুঃখের স্মৃতি। সে পলিকে ভালোবাসত। পলিও তাকে ভালোবাসত। তাই তারা ক্লাসে আবেগে ভরপুর থাকত।
একদিন ইতিহাসের শিক্ষক ক্লাস চলাকালে হাতের ইশারায় আবু তাহেরকে দাঁড়াতে বলেন। সে দাঁড়ায়। আমাদের সবার চোখ তখন তার দিকে। শিক্ষক অযথা সময় নেন। সবার মন দুরু দুরু করতে থাকে। কী হয় কী হয় অবস্থা। শিক্ষক যথাসম্ভব গলা ভারী করে বলেন, ‘এই ছেলে, আমি যতক্ষণ ক্লাসে থাকব আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, মেয়েদের দিকে তাকাবে না।’ সকল ছাত্রছাত্রী স্তব্ধ হয়ে যায়। ভালো ব্যবহারের কারণে আবু তাহের সবার প্রিয় ছিল। আমি সহপাঠীদের মন বুঝতে চেষ্টা করি। বোধ করি সবাই সমবেদনায় কাতর। সবার চোখে জলের আভাস। ক্লাস শেষে আবু তাহের আর আমি কলেজের বাইরের সিঁড়িতে বসি। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকি। সবাই চলে যায়। আমরা নীরবে বসে থাকি। লজ্জায়, কষ্টে সে কুঁকড়ে যায়। তারপর রাগে, ক্ষোভে কাঁপতে থাকে। ভেতরে এক অন্য ধরনের মিথস্ক্রিয়া হয়। আবু তাহের সিঁড়িতে বসেই গরগর করে বমি করে। তারপর উচ্চস্বরে বলে, ‘রাজাকার, উনি রাজাকার। উনি জানেন আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা, তাই আমাকে লজ্জা দিলেন।’ আমি ক্ষোভে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। চিৎকার করে বলি, ‘স্বর্গে গেলেও রাজাকারের মুক্তি নাই।’ রাত অবধি আমরা বসে থাকি, কোনো কথা না বলে। তারপর আমরা দুজন ইতিহাস ক্লাস চিরতরে বর্জনের সিদ্ধান্ত নিই। আমরা সেই বুকভরা কষ্ট নিয়ে পরীক্ষা অবধি কলেজ করি। পরীক্ষার পর আমরা নিজেদের অন্যের কাছে হারিয়ে ফেলি।
এই আবু তাহেরের সাথে পরিচয় নিউইয়র্কে এসে। দুজন একই ধরনের কাজ করি, দুই প্রতিষ্ঠানে। দেখা হলে কাজ-সংক্রান্ত কথা হয়, কথা হয় দুই প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। মাঝেমধ্যে ছেলেবেলার দুষ্টুমি-ফাজলামির কথা আসে। দু-চার দিন আড্ডা হয়। আড্ডায় বৃদ্ধ বয়সে কী কী সুবিধা পাব, এখানে থাকব না বাংলাদেশে যাব ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা হয়।
কিন্তু আজ আবু তাহের অন্য কথা বলে। কী কথা সেটাই বুঝতে চেষ্টা করি।
আমরা কফি কিনি ম্যাকডোনাল্ড থেকে। অর্ডার করে যখন কফির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন এক মেয়েকে নিয়ে তার দুই ছেলেবন্ধু চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। মেয়েটা ছেলেবন্ধুদের থামানোর চেষ্টা করে। ম্যাকডোনাল্ড থেকে বের হওয়া অবধি তাদের ঝগড়া থামে না।
আবু তাহের কি তাদের নিয়েই কথাটা বলেছে? হবে হয়তো। ওরা বলতে কাকে বুঝিয়েছে? প্রেমিক-প্রেমিকাকে? নাকি নারীদের? সে নারীদের কড়া শাসনের কথা বলে। পথেঘাটে নারী দেখলে তাকে বলতে শুনি, ‘তার যে ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তিনি মেয়েদের ঘরের ভেতর রাখতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন।’ প্রতিবাদ না করে শুনি, ভদ্রতার খাতিরে শুনতে হয়। কিন্তু ওর এলাকার বদরুল হাসান বলে, আবু তাহের সচেতনভাবে মিথ্যা কথা বলে। তার ভাই রাজাকার ছিল এবং ব্যক্তিগত কারণে অন্য রাজাকার দ্বারা খুন হয়। সেই আবু তাহের আজ কী কারণে এমন কথা বলে?
আর অপেক্ষা নয়, এখন সোজাসাপটা জানার সময়। কফিতে ঘন ঘন দু-তিন চুমুক দিয়ে আবু তাহেরের কাছে জানতে চাই।
: কী যেন বলছিলে?
: তার আগে বলো তুমি ওই মেয়ের সাথে ছবি তুললে কেন?
আমি হাসি। আবু তাহের রাগে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সেটা দেখে আমার আরও হাসি পায়। রাগে সে ফোঁসফোঁস করে। বিষয়টা খারাপের দিকে যেতে পারে ভেবে চট করে বলি,
: আমি তো ছবি তুলি নাই। কিন্তু ছবি না তুলে কিছু দিলে সে যদি কষ্ট পায়, তাই ছবি তোলার অভিনয় করেছি।
: তাকে কিছু দেওয়ারই-বা কী দরকার ছিল?
: মানুষকে সম্মান করে নিজে সম্মানিত হই।
আবু তাহের আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যভরে মুচকি হাসি দেয়। তারপর সময় নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
: ম্যাকডোনাল্ডে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখো নাই?
যা ভাবছিলাম তা-ই। কিন্তু ঠিক কিসে ওর আপত্তি বোঝা গেল না। বোঝার চেষ্টা করি।
: এই বয়সে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ একটু-আধটু হয়।
: কিসের প্রেম-ভালোবাসা? মেয়েদের সব ছলনা। ও ইচ্ছা করে দুই ছেলেকে ঘুরিয়েছে। নারীরা এখানে ছলনা করে, পরকালেও তা-ই করবে।
জন্মদাতা মায়ের, সহধর্মিণীর, মেয়ের সম্মান রাখতে না পারার বেদনা মুহূর্তে বুকের ভেতরটা শূন্য করে দেয়। বুক ধড়পড় শুরু করে। তারপর ঠিক কী হলো বলতে পারব না। বন্যার পানির তোড়ে যেমন বাঁধ ভেঙে যায়, তেমনি বুকের ভেতর থেকে ডুকরে কান্না বেরিয়ে আসে। টাইম স্কয়ারের জনতার উপস্থিতি আমার মগজ থেকে সমূলে মুছে যায়। আমি সজোরে কাঁদতে থাকি। কাঁদতে কাঁদতে হাডসন নদীর দিকে জোরে জোরে হাঁটি। একমাত্র নদীই এই চোখের জল ধরে রাখতে পারে।