রমজানের ইবাদত পারিবারিকসামাজিক প্রস্তুতি

মারুফ খান

রমজানের প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হচ্ছে ইবাদতের প্রস্তুতি। রমজান হচ্ছে আমাদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পাঠানো চিঠি কোরআনের মাস। যে চিঠিটা প্রতিদিন পড়া প্রয়োজন এবং সে অনুযায়ী আমল করা প্রয়োজন। অথচ হয়তো সেটা অনেকেরই করা হয়ে ওঠে না। তাই এই রমজানের আগেই আমাদের রবের পাঠানো চিঠি কোরআনকে বন্ধু বানিয়ে ফেলুন।
হঠাৎ কারও সঙ্গে পরিচিত হলে কিন্তু মনের কথা সে ভালোভাবে বুঝতে পারে না। কিন্তু যদি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় এবং সম্পর্ক গভীর হয়, তখন সে না বললেও মনের অনেক কথা বুঝে যায়। আন্তরিক হয়ে সে অনুযায়ী বন্ধুকে সমবেদনা জানায়, সহযোগিতা করে।
তাই কোরআনের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা বাড়াতে হবে আজ থেকে। রমজানে যেন এই কোরআনই আপনার প্রিয় বন্ধু হয়ে যায়। আজ প্রথমাংশে ইবাদতের প্রস্তুতি হিসেবে শুধু কোরআনের কথাই লিখব।

১) যেসব ভাইবোন কোরআন পড়তে জানেন না, তারা রমজানের আগেই কোরআন শেখা শুরু করে দিন। তাজবিদসহ কোরআন সহিহভাবে পড়তে জানাটা কিন্তু ফরজে কেফায়া।
এ ছাড়া কোরআনের একটি হরফ পড়লে আপনি দশটি নেকি পাবেন। আর রমজানে যেকোনো আমলের সওয়াব সত্তর গুণ বর্ধিত করা হয়। তাহলে কোরআনের একেকটি আয়াতে আপনি কত বেশি সওয়াবের মালিক হবেন, সুবহান আল্লাহ! চিন্তা করে দেখুন।
২) যারা মোটামুটি পড়তে জানেন, তারা আবার শুদ্ধ করে নিন, যেন তাজবিদ সঠিক হয়। তাজবিদ শুদ্ধ না হলে বা কোরআন ভুলভাবে পড়লে গোনাহ হবে।
৩) যারা নতুন করে শিখছেন বা শিখেছেন, তবে আস্তে আস্তে আটকে আটকে পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে মন খারাপ করছেন, অন্যদের মতো সুন্দর করে কেন পারছেন না? তাদের জন্য তো সুসংবাদ আছেই। হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যারা আটকে আটকে পড়ে, তাদের জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব! সুবহান আল্লাহ! এবার নিশ্চয় মন খারাপ হবে না।
৪) আর যেসব ভাইবোন তাজবিদসহ শুদ্ধভাবে পড়তে জানেন আলহামদুলিল্লাহ, তারা হিফজের একটা টার্গেট করে নিতে পারেন। এই রমজানের আগে বা রমজানে দুটি বা একটি সুরা হলেও হিফজ করবেন ইনশা আল্লাহ।
৫) যারা কোরআন খতম করার ইচ্ছা রাখেন, তারা এখন থেকে বেশি বেশি করে পড়া শুরু করলে রমজানে পড়তে আর বেশি কষ্ট হবে না। প্রতি ওয়াক্ত সালাতের পর কয়েক পেজ করে পড়ার একটি টার্গেট করতে পারেন। তাহলে খতমের টার্গেট পূরণ হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।
৬) অনেক বোন আছেন গর্ভবতী বা অন্যভাবে অসুস্থ অথবা দুরন্ত বাচ্চাকে সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। তারা হয়তো ভাবছেন কোরআন পড়বেন কীভাবে? পড়তে পারবেন না ভেবে মনটাও খারাপ করছেন। তারা মন খারাপ করবেন না প্লিজ। খুব ইজি টেকনিক অ্যাপ্লাই করতে পারেন। প্রতি ওয়াক্ত সালাতের পর সুরা ইখলাস অন্তত তিনবার পড়ে ফেলবেন। এতে আপনি আল কোরআন একবার খতম করার সওয়াব পেয়ে যাবেন। আর যদি দশবার পড়তে পারেন, তবে জান্নাতে আপনার জন্য একটি ঘর রেডি থাকবে ইনশা আল্লাহ।
৭) যারা কোরআন পড়তে পারবেন না বলে মনে করেন, তারা অন্তত কোরআনের তরজমা/তাফসির হলেও পড়বেন ইনশা আল্লাহ। এ ছাড়া কোরআন পড়ার পাশাপাশি কিছু সময় তরজমা/তাফসির পড়ার জন্য রাখতে পারেন। কারণ অর্থ বুঝে কোরআন পড়ার গুরুত্ব অন্য রকম। বোঝার পাশাপাশি আমল করতে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করবে।
৮) গর্ভবতী, অসুস্থ, ব্যস্ত মা-বোনদের জন্য আরেকটি সহজ উপায় হচ্ছে কোরআন তেলাওয়াত শোনা। ঘর গোছাতে গোছাতে বা কিচেনে কোনো কাজ করতে করতে আপনি খুব সহজেই কোরআন তেলাওয়াত শুনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যেমনিভাবে সওয়াব জমা হবে আপনার আমলনামায়; তেমনিভাবে কোনো আয়াত বা সুরা মুখস্থ করতে চাইলে সেটা অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি মুখস্থ হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। ঘরে কোরআন তেলাওয়াত চালিয়ে রাখলে বাচ্চারাও শুনে শুনে অনেক কিছু আত্মস্থ করে ফেলে আলহামদুলিল্লাহ। ঘর থেকে শয়তান দূরীভূত হয়, আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় অর্থাৎ সর্বোপরি ঘরে একটা পবিত্র অবস্থা বিরাজ করে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখো এবং নিশ্চুপ থাকো, যাতে তোমাদের ওপর রহমত হয়।’ [৭:২০৪]
৯) আপনি হয়তো কোথাও যাচ্ছেন বা ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছেন, তখনো সময়টাকে কাজে লাগাতে পারেন ইয়ারফোনে অথবা গাড়ির অডিওতে কোরআন তেলাওয়াত শুনে।
রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে ইবাদতের প্রস্তুতির পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক কিছু প্রস্তুতির কথা বলাও জরুরি। কারণ যত তাড়াতাড়ি এগুলোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হবে, কাজ গোছানো শুরু হবে; রমজানের জন্য প্রস্তুতি তত তাড়াতাড়ি ও ভালোভাবে সম্পন্ন হবে ইনশা আল্লাহ।

রমজান পুরোটাই ইবাদতের মাস, সংযম সাধনার মাস। তাই এই মাস আসার আগেই আমাদের এমন কিছু কাজ গুছিয়ে রাখতে হবে, যেগুলো দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য ফলপ্রসূ। গুছিয়ে রাখতে হবে এ জন্য যে, রমজানে যেন এ কাজগুলো করতে গিয়ে আমাদের অতি মূল্যবান সময় নষ্ট না হয়।

১) এই কাজগুলোর একটি হচ্ছে নিজেদের জন্য, আত্মীয়স্বজন বা অন্যদের জন্য শপিং করা। রমজান এলে দেখা যায়, বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে ঘুরে ঈদের জন্য শপিং করতে করতে বাসায় এসে ইবাদত করার আর টাইম বা এনার্জি কোনোটাই থাকে না। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরিতে দৃষ্টির হেফাজত, অন্তরের হেফাজত দুটিই বাধাগ্রস্ত হয়। তাই রমজান আসার আগেই সবার জন্য পছন্দের শপিং সেরে ফেলুন। এ ছাড়া বর্তমানে অনেকেই শপিং মলে হাঁটাহাঁটির ঝামেলা কমাতে অনলাইন থেকে কেনাকাটা করে নেন। তবে এ ক্ষেত্রে আপনার পরিচিত বা বিশ্বস্ত অনলাইন পেজ থেকে শপিং করে নিতে পারেন।
২) জাকাত যে একেবারে রমজানেই দিতে হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই। তাই আপনার জাকাতের টাকা হিসাব করে সে টাকা রমজান আসার আগেই প্রাপকদের বুঝিয়ে দিতে পারেন। জাকাত দেবেন নগদ টাকা দিয়ে, যেন সে তার কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারে। আর কাপড়চোপড় দেবেন সাদকা হিসেবে। তাই সাদকার উদ্দেশ্যে শাড়ি, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, বোরকা, খিমার ইত্যাদি কিনে রাখতে পারেন। রমজানের আগে বা রমজানের প্রথম সপ্তাহেই দান করে দিতে পারেন। আপনার নিয়ত তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দেখছেন।
৩) রমজান আসার আগেই আত্মীয়স্বজনদের বাসায় ইফতারসামগ্রী কিনে পৌঁছে দিতে পারেন। বিভিন্ন ধরনের ইফতার বক্স, ঈদ গিফট বক্স রেডি করে নিতে পারেন। মসজিদ, মাদ্রাসায় বা অন্যান্য দরিদ্র, মিসকিনদের রমজানের জন্য ইফতারসামগ্রী বা সাহ্রির জন্য খাদ্যদ্রব্য কিনে রমজানের আগেই পৌঁছে দেওয়া যায়। আপনার বাসার দারোয়ান বা খাদেমাদেরও এ সাদকার অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। তাহলে আপনি পুরো রমজানে অন্যকে ইফতার করানোর সওয়াব পেয়ে যাবেন ইনশা আল্লাহ।
৪) যেখানে পানি সংকট আছে, সে জায়গায় রমজানের আগেই আমরা কেউ টিউবওয়েল স্থাপনে সহযোগিতা করতে পারি। এ ছাড়া যেখানে মানুষের ভিড় বা যাতায়াত বেশি থাকে, তেমন স্থানে রমজানে শরবত বা পানির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তৃষ্ণার্ত সায়েম পানি পান করলে যে কৃতজ্ঞতা অনুভব করে, তা অতুলনীয়। এর বিনিময়ে আপনার জন্য দোয়া ও সওয়াব জমা হবে ইনশা আল্লাহ। এ ছাড়া কাউকে পানি পান করানো সর্বোত্তম সাদকা। টিউবওয়েল স্থাপন একটি সাদকায়ে জারিয়া।
৫) কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা, গ্রন্থাগারে ছাত্রদের বা মুসল্লিদের পড়ার জন্য কোরআন কিনে দিতে পারেন। হাদিসগ্রন্থ বা তাফসির ইবনে কাসিরও কিনে দিতে পারেন। মসজিদে কার্পেট, ফ্যান, জায়নামাজ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যার যার সামর্থ্যানুযায়ী কিনে দিতে পারেন।
৬) এ ছাড়া আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে রমজানে পড়ার জন্য দাওয়াহর নিয়তে ভালো বই হাদিয়া দিতে পারেন। (১১-এর পাতার পর)
ছোট ছোট দোয়ার বই, জিকিরের বই, কার্ড, লিফলেট ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করতে পারেন। এ ছাড়া রমজানের বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কিত লিফলেটও বিতরণ করতে পারেন।
৭) বাসার জন্য একটি সাদকাহ বক্স বানাতে পারেন। যেকোনো ছোটখাটো বিপদ, অসুস্থতা থেকে শুরু করে বড় অসুস্থতার সময়ে ওখানে সাদকাহ রেখে দেবেন। এ ছাড়া এমনিতেও রাখতে পারেন। কারণ কেউ কেউ মনে করেন, কীভাবে, কাকে প্রতিদিন সাদকাহ করবেন। এভাবে সাদকাহ বক্সে সাদকাহ জমানো শুরু করলে একসময় একসঙ্গে কাউকে দেওয়া যায়। অথবা কয়েকজনকে ভাগ করে দেওয়া যায়।
৮) এখন শাবান মাস চলছে, সামনে রমজান। সাদকার জন্য দুটিই উৎকৃষ্ট মাস। তাই প্রতিদিন আমাদের খাদ্যদ্রব্য থেকে, ব্যবহৃত পোশাক বা অন্যান্য বস্তু থেকে অথবা নিজের কোনো সম্পদ থেকে কিছু না কিছু অংশ সাদকা করা প্রয়োজন। হোক না তা অতি ক্ষুদ্র অংশ; দশটি টাকা অথবা একটি রুটি। কিন্তু এর মূল্য আখেরাতে বিশাল হবে ইনশা আল্লাহ।
সাদকা আপনার, আমার ছোটখাটো গোনাহগুলোকে মুছে ফেলবে। যেমনিভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামান্য একটি খেজুরের বিনিময়ে হলেও আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার নির্দেশ দিয়েছেন।

রমজানে যেমনিভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝড়ের গতিতে দান করতেন, তেমনি শাবান মাসেও প্রচুর দান করতেন। তাই রমজানের পাশাপাশি শাবান মাসেও দান-সাদকার পরিমাণ বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বাড়িয়ে দিতে পারেন। আজকের জন্য এতটুকুই লিখলাম। কোনো পয়েন্ট বাদ পড়লে আপনি যোগ করে নেবেন ইনশা আল্লাহ। তো আসুন, আজ থেকেই রমজানের ইবাদত ও পারিবারিক-সামাজিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি ইনশা আল্লাহ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।