
ঠিকানা রিপোর্ট : চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২৩ মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পবিত্র রমজান মাসকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার পুরোপুরি প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী রমজানের বাজার করেছেন। আয়োজন করছেন পারিবারিকভাবে ইফতারের। এদিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন মসজিদে ইফতারের আয়োজন করা হবে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিভিন্ন মসজিদে ইফতারির জন্য অর্থ দিচ্ছেন। কেউ কেউ অনেক আগে থেকেই মসজিদে ইফতার করানোর জন্য বুকিং দিচ্ছেন। মসজিদ কর্তৃপক্ষ যিনি যেদিন অর্থ দিচ্ছেন বা দিতে চাইছেন বা ইফতারির স্পন্সর করছেন, সে অনুযায়ী তাদের নাম লিপিবদ্ধ করছে। প্রথম রোজা, শবে কদরের দিনে এবং শেষ রমজানের দিন ইফতার করানোর চাহিদা বেশি। এ ছাড়া রোজার অন্য দিনগুলোতেও অনেকে মসজিদে মুসল্লিদের ইফতার করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন মসজিদে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইফতারির আয়োজন করা ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগ, জেলা, উপজেলা, থানা, আঞ্চলিক সংগঠন ও পেশাভিত্তিক সংগঠন ইফতারির আয়োজন করছে। বাংলাদেশ সোসাইটি, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের মতো বড় বড় সংগঠন বড় পরিসরে ইফতারির আয়োজন করছে। এসব ইফতার পার্টি ও দোয়া মাহফিলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হল ও পার্টি সেন্টার আগাম বুকিং হচ্ছে। গত মাস থেকেই বিভিন্ন সংগঠন ইফতারির জন্য হল বুকিং দিতে থাকে। অতিথির সংখ্যা অনুযায়ী তারা বুকিং দিচ্ছে।
জানা গেছে, এবারের ইফতারির প্যাকেজের মূল্য গত বছরের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। সব জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে ইফতার বক্সের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে। নিউইয়র্কের রেস্টুরেন্টের একাধিক মালিকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। একটি রেস্টুরেন্টের মালিক বলেন, বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি, ফলে ইফতারির বাজারেও দাম বেড়েছে।
একজন ইমাম বলেন, আমরা গত বছর জ্যামাইকার একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট থেকে রমজানের জন্য প্যাকেটপ্রতি চার থেকে পাঁচ ডলারে ইফতারি নিয়েছি। এবার এখনো প্রাইজ চূড়ান্ত করেনি। তবে বলেছে, গত বছরের তুলনায় দাম একটু বেশি হবে। তারা সাধারণ ক্রেতার জন্য ইফতারি যে দামে বিক্রি করে, মসজিদের জন্য তা থেকে কিছুটা কম নেয়। তারা রোজাদারদের জন্য বিশেষ মূল্য অর্থাৎ কেবল খরচটাই রাখে।
জ্যামাইকা, কুইন্স ভিলেজ, বেলরোজ, জ্যাকসন হাইটস, সাটফিন, ব্রায়ারউড, পারসন্স, এস্টোরিয়া, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কসের বিভিন্ন এলাকার বাংলাদেশি, ভারতীয় পাকিস্তানি ছাড়াও অন্যান্য দেশের মুসলিম কমিউনিটির মানুষেরা ইফতারির ব্যাপক আয়োজন করছেন। করোনা কমে যাওয়ায় এবার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। ফলে গত দুই বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি ইফতার পার্টি হবে।
এদিকে রমজান উপলক্ষে গ্রোসারিগুলোতে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও বাজারে জিনিসপত্রের দাম তেমন কমেনি। বরং দাম গত বছরের তুলনায় কিছু কিছু দোকানে বেড়েছে। তবে কিছু দোকান আছে, যেগুলোতে দাম গত বছরের চেয়ে কিছুটা কমেছে। নিউইয়র্ক সিটির বিভিন্ন বরোতে গ্রোসারিগুলো এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। মানুষের কেনাকাটা বেড়েছে। রমজানের কারণে ইফতারি সামগ্রী ও সাহ্রির পণ্যসামগ্রীর বিক্রি বেশি। এর মধ্যে খেজুর, ছোলা, ডাল, তেল, লবণ, বেসন, বিরিয়ানি ও তেহারির মসলা, মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন জিনিস রয়েছে। ফলের চাহিদাও ব্যাপক। চাহিদা রয়েছে বিভিন্ন জুসেরও। রমজানে খেজুরের চাহিদা অনেক বেশি থাকে। আগে বড় বক্সের চাহিদা বেশি থাকলেও এবার ছোট বক্সের চাহিদা বেশি।
এ ব্যাপারে মাছ বাজারের কর্ণধার রুমি ভুঁইয়া বলেন, গত বছরের তুলনায় বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়ছে। এ কারণে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করেছে। মাছ বাজার, ভারতীয় প্যাটেল ব্রাদার্স, আপনাবাজারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্যের দাম কমাতে শুরু করেছে। বিক্রিও বাড়ছে। জানুয়ারি মাসে বিক্রি বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা ১৯ শতাংশ। মার্চে আরো বাড়বে বলে আশা করছি। ন্যূনতম ৩০ শতাংশ বাড়বে। আমরা প্রাইজ ম্যাচ করি। এ কারণে মানুষ আমাদের কাছ থেকে কম দামে পণ্য কিনতে পারেন। বাংলাদেশি দোকানগুলোর মধ্যে আমাদের দোকানে জিনিসের দাম কম। আমি আপনাবাজার প্যাটেলের সঙ্গে প্রাইজ ম্যাচ করেই বিক্রি করছি। কোনো জিনিসের দাম বেশি রাখছি না। শুনেছি জ্যামাইকায় জ্যাকসন হাইটসের চেয়ে জিনিসের দাম বেশি। এটি হওয়া উচিত নয়। কারণ আমরা যে দামে পণ্য আনছি, তারাও তো সেই দামেই আনছে। তাহলে মানুষ বেশি দামে কেন পণ্য কিনবে?
দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়া, ইনফ্লাশন, নানা কারণে আয় কমে যাওয়া ও স্বল্প আয়ের মানুষের খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক মানুষ স্ন্যাপ বেনিফিট নিচ্ছে। মানুষ স্ন্যাপ কার্ডে অনেক কেনাকাটা করছে। বলা যায়, ৭০ শতাংশ মানুষ স্ন্যাপ কার্ড ব্যবহার করছে। অন্যদিকে ক্রেডিট কার্ড এবং ক্যাশেও কিনছে। মসলার বাজারে ছোয়াদ ও স্কয়ারের রাঁধুনির মসলার চাহিদা বেশি। কালো ছোলা, আস্ত মসুর, রেগুলার মসুর ডাল, বেসন এগুলোর দাম আগের চেয়ে কমতে শুরু করেছে। আগের বছর যে প্যাকেট ৪.৫০ ডলার ছিল, এবার সাড়ে তিন ডলার করে কিনছি। চার ডলার করে বিক্রি করছি। কনটেইনারের ভাড়া কমছে। ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ কমছে। তাই জিনিসপত্রের দাম আরো কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আমরা প্রচুর পণ্য দোকানে উঠিয়েছি। বাজারে পণ্যের ঘাটতি নেই। বাংলাদেশের কালিজিরা চালের ঘাটতি আছে। এ জন্য দাম বেশি। ইনফ্লাশন কমতে শুরু করেছে। সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশি চালের দাম বাজারে কমেনি। বাংলাদেশ থেকে কালিজিরা চাল বের হতে দিচ্ছে না। পোলাওর চাল আগে যেগুলো মজুদ ছিল, সেগুলো বাজারে আসছে। রুমি ভুঁইয়া বলেন, তেলের দাম কমছে। ৬০ ডলারেরটি ৫৫ ডলার, ৫০ ডলারেরটি ৪৫ ডলার হয়েছে।
খামার বাড়ির কর্ণধার কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, রমজান উপলক্ষে আমরা জ্যামাইকা ও জ্যাকসন হাইটসের দোকানে অনেক পণ্য ওঠাচ্ছি। বেচাবিক্রিও ভালো। মানুষের কেনাকাটার হার বেড়েছে। রোজা উপলক্ষে মানুষ অনেক কিছু কিনছে। আশার কথা হলো, এবার জিনিসপত্রের দাম গতবারের তুলনায় একটু কমেছে। এর কারণ পণ্য পরিবহনের কন্টেইনারের ভাড়া কমতে শুরু করেছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম আরো কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, যার কাছে যে ধরনের অর্থ পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে, তিনি সে ধরনের সুবিধা নিচ্ছেন। স্ন্যাপ কার্ডে অনেকেই কিনছে, বাকিরা ক্রেডিট কার্ডে। ক্যাশে কেনার হার কম। তিনি বলেন, খেজুরের মধ্যে এবার বড় প্যাকেটের চেয়ে ছোট প্যাকেটের চাহিদা বেশি। চার পাউন্ডের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ২৩-২৪ ডলারে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কিছু কিছু পণ্যের দাম একেক দোকানে একেক রকম। এ কারণে ক্রেতারা বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। একজন ক্রেতা বলেন, জ্যামাইকার চেয়ে জ্যাকসন হাইটসের কিছু কিছু দোকানে জিনিসের দাম কিছুটা কম। এ কারণে এখন জ্যামাইকা থেকে বাজার না করে জ্যাকসন হাইটস থেকে করছি। এতে করে কিছু অর্থ বেঁচে যাচ্ছে। আমি মনে করি, জ্যাকসন হাইটসেও দাম আরো কমানো উচিত।
জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের পরিচালনা পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরা গত দুই বছর প্যান্ডামিকের কারণে রোজাদারদের মসজিদে ভালোভাবে ইফতার করাতে পারি। আমরা কেবল পানি ও খেজুর দিতাম। সেটি আমরাই স্পন্সর করতাম। যারা বিভিন্ন দিনে ইফতার দিতেন, তাদের সেই খাবার হোটেলে অর্ডার করে দিতাম। তারা ইফতার বক্স দিতেন। আমরা সেই বক্স নামাজের পরে দিতাম। এবার করোনা বলতে গেলে নেই। আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী রোববার বৈঠক করছি। তিনি বলেন, বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিলে আগের মতো মানুষ ইফতার স্পন্সর করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে মসজিদে অর্থ দিতে পারবেন।
খলিল বিরিয়ানির কর্ণধার খলিলুর রহমান বলেন, ইফতার উপলক্ষে আমাদের বিশেষ আয়োজন চলছে। সবচেয়ে বেশি ইফতারি আমরা কমিউনিটিতে এবং মসজিদে সরবরাহ করব। আমাদের প্যাকেট ইফতারি ছাড়াও রয়েছে ক্যাটারিংয়ের বিশেষ ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে আমাদের ব্রঙ্কসের খলিল চায়নিজ এবং জ্যামাইকা খলিল বিরিয়ানির পার্টি হলে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হবে। বিশেষ ইফতারি বক্স ১১.৯৯ এবং রেগুলোর বক্স এবার ৯.৯৯ ডলার করে নেওয়া হবে। গতবারও একই দাম ছিল। এবার সব জিনিসের দাম গতবারের তুলনায় বাড়লেও আমরা ইফতারির দাম বাড়াইনি। বরং কিছু কিছু আইটেমের দাম কমানোর চেষ্টা করছি।