রম্য: উন্নয়নের প্রসববেদনা কথায় জিপিএ ফাইভ

মোস্তফা কামাল

বরাবরের মতো এবারের ঈদেও সড়ক, নৌ, স্বরাষ্ট্রসহ মন্ত্রীরা, পুলিশের উচ্চপদস্থরা সড়ক-মহাসড়কে কোনো যানজট না হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বাস্তবে তথৈবচ। যা হবার তা-ই হলো। যানজট, টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে বেশুমার প্রাণহানিসহ কোনো আজাবই বাদ যায়নি। এরপরও মন্ত্রীদের দাবিÑ এবার মানুষ কম মরেছে!
এতো এতো ফোর লেন আর ওভার ব্রিজে উন্নয়নের প্রসববেদনা হজম করা তাদের নিয়তি। বিপরীতে যানজট সৃষ্টিতে শতভাগ সাফল্য। কথার বাহাদুরিতে গোল্ডেন জিপিএ! স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পরে বিজ্ঞানে বাঙালির বৈপ্লবিক আবিষ্কার নেই- এই হাহাকার দীর্ঘদিনের। এখন আধঘণ্টার মাঝারি বৃষ্টিতেই ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরের পথগুলো উত্তাল সমুদ্র হয়ে যায়। বাস-ট্যাক্সি-সিএনজি- এমন কি রিকশা আর রিকশাভ্যানগুলোও সাবমেরিন হয়ে যায়। এটা যুগান্তকারী আবিষ্কার!
আমেরিকা-ইউরোপ, এশিয়ার বিত্তশালী রাষ্ট্রগুলো আমাদের এ উন্নয়নের পাসওয়ার্ড জেনে না ফেললেই রক্ষা। রিকশা কিভাবে সাবমেরিনে রূপান্তর হয়, তা আরো শতবছর চেষ্টা করলেও আবিস্কারের মুরদ তাদের হবে না! বিভিন্ন সূচকে উন্নয়নের মত জলবদ্ধতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং দায়িত্বশীলদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জলাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা শহর জুড়ে বর্ষাকালীণ সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। এই সমুদ্রবন্দরগুলোকে অক্ষত রাখতে বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতের জন্য সাবমেরিন সার্ভিস চালু করলেই কেল্লা পথে। এই সাবমেরিনগুলো রাজধানীর জুরাইন চ্যানেল হতে মিরপুর সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত চলাচল করতে পারবে। পর্যায়ক্রমে চালু করা যাবে ঢাকা শহরের অন্যান্য সড়কেও।
অনেকে রসিকতা করে বলেন- যানজট, জলজট, জনজট উন্নয়নের প্রসব বেদনা। এগুলো না থাকলে দেশের উন্নযন বোঝারও কিছু থাকে না। ভিনদেশি কারো তা দেখে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা বা অজান্তে লুঙ্গি খুলে গেলেই বা কি? ভদ্রলোকের এক জবানের মতো গত ক’বছর ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলে আসছেন ঈদে মহাসড়কে যানজট হবে না। এবারও বলেছেন। কারণ ‘এক জবান’ রক্ষায় তিনি জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলেন। ফলে মধ্যরাতে দেশে ফিরেই প্রধানমন্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, মহাসড়কের অবস্থা কী? তখনও তিনি বলেছেন- নেত্রী, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো। কোনো যানজট নেই।
নেত্রী তার কথা নিশ্চয় বিশ্বাসও করেছেন। বিমানবন্দর থেকে নিজের বাসভবনে যাওয়া পর্যন্ত উনি কোনো যানজট পাননি। আবার, উনি যখনই কোথায় যান বা বাসায় ফিরেন তখনও কোনো যানজট পান না!
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই কাঁচপুর, মেঘনা ব্রিজ চালু হবে। বাকী সড়কগুলোকে পর্যায়ক্রমে চার লেইন করে দেবো। ফলে আর কখনও কোনো যানজট হবে না। কিছু মানুষ বুঝতে ভুল করে। তারা জানে না, এতো ফ্লাইওভার, এতো ফোর লেইন, এতো বাইলেইন আর বাইপাস নির্মাণ করা হয়েছে গাড়ি চলাচলের জন্য। যানজট কমানোর জন্য নয়। কিছু দুর্মুখ বলে, পকেট ভরার জন্য অপরিকল্পিতভাবে এসব কাজ করা হয়েছে। কিন্তু তারা খেয়াল করে না, মন্ত্রীর রঙিলা মুজিব কোটের বুক পকেটে লাল রুমাল ছাড়া আর কিছু নেই।
এছাড়া যানজট নিয়েও অপপ্রচার হচ্ছে। সারা ঢাকা শহরের রাস্তা যখন যানজটে আটকে থাকে, তখন সংসদ ভবনের সামনের ভিআইপি সড়ক বিশেষ ব্যবস্থায় খালি করিয়ে সেখানে লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে মন্ত্রী প্রমাণ করে দিয়েছেন, ঢাকা শহরে যানজট বলে কিছু নেই। অচিরেই তা তিনি চট্টগ্রামেও প্রমাণ করার হিম্মত রাখেন।
মানসিকতা, চর্চাসহ যাবতীয় বাস্তবতা এ জায়গায় এসেই ঠেকেছে। এমন তলানির প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পাচ্ছে আমাদের নাটক-সিনেমায়ও। বিভিন্ন চ্যানেলে এবারের ঈদের নাটকগুলোর নাম ও সংলাপ সেই ইংগিতই করে। থাবড়াইয়া চোবাড় দাঁত ফালাই দিমু; ফাহিম দ্য গ্রেট ফাজিল; মুরগি মতিন; মেজাজ ফরটি নাইন; জিন্সের তক্তা ধরনের নাম খামাখা আসেনি। এগুলো ভালো দর্শক টেনেছে। বিজ্ঞাপনও পেয়েছে প্রচুর। তা তো সমাজেরই আয়না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।