রম্য: গাড়িচাপায় জীবন, টাকাচাপায় আইন

মোস্তফা কামাল

ক্ষমতার চাপায় আইন-বিচারও চাপা দেওয়ার ঘটনা দেশে অহরহ। তা ¯্রফেই ঘটনা। দুর্ঘটনা নয়। আইনপ্রণেতা মাননীয়রা তা একটু বেশিই জানেন-বোঝেন। ফলানও। টাকা থাকলে খুন করেও পার পাওয়ার ঘটনার সঙ্গে মানুষ নিয়মিত পরিচিত সেই আদিকাল থেকেই। এতে নয়া উদাহরণ তৈরি করেছেন ক্ষমতাসীন দলের এমপি একরামুল হক চৌধুরী। রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর সেলিম ব্যাপারী নামের একজনকে পিষিয়ে মেরেছেন তার ছেলে শাবাব চৌধুরী। ঘটনার সময়ই এই জুনিয়র মাননীয় বলছিলেন, ‘এটা আমার এলাকা, কে কে আসবি আয়। কত টাকা চাস, পাবি, অফ যা…।’
ঠিকই তিনি সব অফ করে দিয়েছেন। সেলিম ব্যাপারীর প্রাণপ্রদীপ অফ করে দেওয়ার পর বাদবাকি সবকিছু অফ করে দিয়েছেন। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়ে ২০ লাখ টাকায় সেলিম ব্যাপারী হত্যাকা- বিষয়টির সমাধান করেছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবার, বিচারের প্রত্যাশা বাদ দিয়ে, ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন। এটি বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থারই একটা দিক। প্রভাবশালী বিত্তবানরা কাউকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করলে নিহতের পরিবার ২০ লাখ টাকার হকদার। গুলিতে হত্যার বিনিময় একটি ফ্ল্যাট। কিসের মামলা? হলেও তা তুলে নেওয়া হবে। মামলার তদন্তকারীরা আপস প্রক্রিয়ায় অবদান রাখবে। অসহায় পরিবারটি মাথা নিচু করে তা মেনে নেবে। ভাববে যিনি চলে গেছেন তিনি তো আর ফিরে আসবেন না। তা ছাড়া হন্তারা খুব প্রভাবশালী, অনেক টাকার মালিক। মাতামাতি করলে বাড়তি বিপদ আসবে। নিহতের স্ত্রী-সন্তান বা পরিবারের অন্যদের ক্ষতি করে ছাড়বে। তার চেয়ে ক্যাশ টাকা বা ফ্ল্যাট নিয়ে বাকি জীবন সাঙ্গ করাই উত্তম।
আফ্রিকান কিছু হত্যার সামাজিক বৈধতার বিধান রয়েছে। প্রাণী বলি দিয়ে হত্যার মীমাংসা হয় সেখানে। বিত্তবান হত্যাকারী ৫-৭ শ গরু-মহিষ জবাই দিয়ে হত্যার শাস্তি থেকে নাজাত নেয়। রক্ষা পাওয়া যায়। মুসলিম বিশ্বের শিরোকূল সৌদি আরবেও হত্যার আপসের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে হত্যার শাস্তি মৃত্যুদ-। তবে নিহতের পরিবারের সঙ্গে আপসরফায় ‘ব্লাড মানি’ দিয়ে মৃত্যুদ-িত ব্যক্তি রক্ষা পেতে পারেন। বাংলাদেশেও রাখঢাক না রেখে তেমন কিছু করে ফেললেই হয়। আইন চাপা না দিয়ে সংস্কার করলে বাধা দেবে না কেউ। আইন করে ক্ষমতাধরদের সুরক্ষার সঙ্গে গোটা দেশকে তাদের বিনোদনের স্বর্গভূমি করে নেওয়া যায়। সেই ক্ষেত্রে বাধা হচ্ছে বিদ্যমান আইন।
আমাদের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী, গাড়িচাপায় হত্যার শিকার সেলিম ব্যাপারীর স্ত্রী-কন্যা হত্যার দায়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে আপস করতে পারেন না। হত্যার শিকার পরিবার মামলা চালাবেন কি না, সেটাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপস অযোগ্য অপরাধের মামলা চালানোর দায়িত্ব সরকারের। এ কারণেই ফৌজদারি মামলা কোনো ব্যক্তি দায়ের করলেও তা লেখা হয়, ‘রাষ্ট্র বনাম অমুক’। রাষ্ট্রের পক্ষে অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্যই জনগণের অর্থ দিয়ে পিপি নিয়োগ দিয়ে রাখা হয়। এই আইনের প্রণেতা সংসদ সদস্যরা। তারা নিজেরাই তা মানছেন না। গ্রাম-বাংলায়ও ধর্ষিত বা বাবা-মাকে কিছু টাকা, কাপড়চোপড়, কয়েক মণ ধান দিয়ে মিটমাটের রেসালা চালু রয়েছে। সেলিম ব্যাপারী হত্যার আপস ফর্মুলার মতো ক্ষমতাধরদের সোনার টুকরারা ভাবেন, গাড়িচাপায় কাউকে হত্যা করে লাখ বিশেক টাকায় কেস খতম। মানুষ এতে টুকটাক মাইন্ড করে। আজেবাজে কথা বলে। এ ঝুঁটঝামেলার চাইতে ধনবানেরা চাইলে সোজাসিধা আইনই করে নিতে পারেন। কেউ তাদের রুখতে পারবে না। চাপা দেওয়া চালককে গ্রেপ্তার কেন, গাড়িটিও জব্দের পর্ব থাকবে না। আফ্রিকার মতো গরু-ছাগল জবাই দিয়ে খাওয়ানোর বিধানও করতে পারেন তারা। নিশ্চিত বলা যায়, কাঙাল উপচে পড়বে সেই ভুরিভোজে। তা ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজও পাবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন