রম্য: বাবার বাবায় ধন্য সোনার বাংলা

মোস্তফা কামাল

কোটিপতি হতে এখন ডেল কার্নেগি, শিব খেরা, পি জে শার্টজ, এরিক টমাসদের অনুপ্রেরণা লাগে না। অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’তেও যাওয়ার দরকার নেই। কত্ত কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা হয় সেখানে বিল গেটস মাইক্রোসফট নিয়ে গবেষণা করে তো ওই দিকে অ্যাপল নিয়ে গবেষণা করতে করতে স্টিভ জবসের চুল চলে গেছে। সেই আশ্চর্য প্রদীপ এখন সোনার বাংলায় অগুনতি। যার বদৌলতে ফকির থেকে শুরু করে দিনমজুর রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে। এ জন্য কোনো ময়লা বাবা, কয়লা বাবা, ল্যাটা বাবা, ঠেলা বাবার কাছে যেতে হয় না। সব বাবা ফেল। বাবার বাবা এসে গেছে। আর্থিক অবস্থা দুর্বল? ইয়া ইয়া জপতে জপতে কয়েকটা ফাইল হাত বদলালেই তকদির ফকফকা।
এই বাবার অছিলায় কক্সবাজারের মুরগিঅলা মন্তুও আজ শত কোটি টাকার মালিক। রাজধানীর মালিটোলা-ছনটেকের সখিনা-ডালিয়ারাও কোটি কোটি টাকার মালিক। শনির আখড়ার রিকশাঅলা কোব্বাতও কোথাও ঝোপ বুঝে কোপ মেরে ও কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে। নামের সঙ্গে লাগিয়েছে আলহাজ। মহেশখালীর এক খুচরা কর্মকর্তার পিয়ন সোলেমানও গরিব নেই। কোটিপতি ক্লাবের মেম্বার। টেকনাফের পান-বিড়ির ফেরিঅলা রুস্তম, বাস কন্ট্রাক্টর আমির, দিনমজুর শফিকও কোটিপতি বনে গেছে। ভ্যানঅলা ফজু কয়েক কোটি টাকার মালিক। মুরাদপুরের কাঠমিস্ত্রি লায়েক আলী কত টাকার মালিক নিজেও জানে না। একটি গোয়েন্দা শাখার সিপাহি লেভেলের নাসু কবেই কৌন বনেগা কোটিপতি। ঝালকাঠির আনুকে এখন কেউ জেলে বা জাউল্যা বললে খবর আছে। কুমিল্লা পদুয়ার বাজারে ছাতা মাথায় ডিউটি করা ট্রাফিক কনস্টেবল সোলেমান কেন আর এভাবে রোদ-বৃষ্টিতে গতর খাটবে? সে কি দোষ করেছে, সেও কোটিপতি হয়ে গেছে। সামান্য দিনমজুরের জীবন থেকে এখন নামে-বেনামে কয়েকটি বাড়ি, ধনসম্পদ, ব্যাংক ব্যালেন্সের অধিকারী নারায়ণগঞ্জের রোকসানা চট্টগ্রামের হালিশহরের কপর্দকহীন আশরাফ এখন মস্ত দানবীর।
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কেন পাড়া-মহল্লার ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের অনেকেও কোটিপতি। এগুলো একবিংশ শতাব্দীর বাস্তব গল্প দেশে টাকার কমতি-ঘাটতি নেই। চারদিকেই টাকা উড়ছে। আকাশে-বাতাসে টাকা ওড়ে। পানিতেও ভাসে। ঘটনাচক্রে টাকার খনি ধরা পড়ছে মাঝেমধ্যে। হাতে হাতে অকল্পনীয়-অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা। টাকার উৎস নানামুখী। টাকা হাতানোর পথ বেশ প্রশস্ত। অবাধ।
বছর কয়েক আগে থাইল্যান্ডে একটি কচ্ছপের পেট থেকে বের করা হয়েছিল ৫ কেজি ওজনের এক হাজার কয়েন। এ নিয়ে গরম খবর হয়েছিল বিশ্ব মিডিয়ায়। নদীর পাড়ে কাহিল অবস্থায় স্থানীয়রা পেয়েছিল কচ্ছপটিকে। তারা এটিকে নিয়ে যায় পাশের হাসপাতালে। সিটি স্ক্যানে দেখা যায়, কচ্ছপটির পেটে ধাতব জাতীয় পদার্থ। ডাক্তাররা তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ১২ জন চিকিৎসক ৯ ঘণ্টা ধরে তার পেট অপারেশন করে বের করেন কয়েনগুলো। এরপর তাকে বিশেষ সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়। কচ্ছপটি এত কয়েন কোথা থেকে পেল সেই রহস্য উদ্ধার করা যায়নি। পরে কচ্ছপটির নামে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন তারা। সেই অ্যাকাউন্টে বহু ‘ফ্রেন্ড’ও যোগ হয়। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সেটি মামুলি খবর।
বাংলাদেশে টাকার এমন ছড়াছড়িতে উদ্বুদ্ধ, পুলকিত বিদেশিরা। সেকেন্ড হোম করে দেওয়ার ঘটক-দালালরা বেশ তৎপর। বাংলাদেশিদের লোভনীয় নানা অফার দিচ্ছে তারা। অবশ্য এর আগে থেকেই টাকার জোরে বিশ্বের দেশে দেশে বাঙালির নীরব দখল কায়েম হয়ে আসছে। মালয়েশিয়া, আমেরিকা, কানাডার মতো ধনী দেশের জায়গা-সম্পত্তি কিনছে বাঙালরা। বিদেশি জমি-ফ্ল্যাট-পার্কিং স্পটসহ অনেক কিছু হাত করে নিচ্ছি আমরা। আমেরিকার জ্যামাইকাতে সম্প্রতি আমাদের এক মন্ত্রীপুত্রের ১২টি ফ্ল্যাট আর চারটি পার্কিং স্পটের মালিকানা কেনার খবরে আরো অনেকে উৎসাহিত।
দেশ থেকে পাচার করা টাকার একটা সিংহভাগ বিনিয়োগ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে। কানাডায় বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোমের নাম ‘বেগম পাড়া’। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ‘সচিব পাড়া’। থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরের সেকেন্ড হোমে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও কম নয়। সুইস ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশিদের বিদেশে টাকা পাচারের কিছু হিসাব উঠে এসেছে। এ ধরনের চুরি বা পাচারকে কারো কারো লেনদেন বলতে পছন্দ। আবার কেউ বলেন রফতানি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমেও দেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। পাচার ও ক্রয়যাত্রার এ ধারা অব্যাহত থাকলে ইনশা আল্লাহ একসময় সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ধনী আরো অনেক দেশের ধনে ভাগ বসাবে বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন