রম্য: ভোটের ময়দানে ইহাদেরই কদর

মোস্তফা কামাল

ভোট এলে শয়তানগুলো ফেরেশতা হয়ে যায়। খলনায়কেরাই হয় নায়ক। মানুষ তাদেরই খায়। বিড়ি খাওয়ালেও খুশি হয়। ম্যাঙ্গো পিপল নামে পরিচিত মানুষও হাল বুঝে পাল তুলছে। তাল দিচ্ছে। একবার ধানের শীষের দিকে ছুটলে পাপমোচনের জন্য পরেরবার স্বাদ নেয় নৌকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাভ হয় না। বারবার মনে হয়, আগের জনই বোধ হয় ভালো ছিল। কিন্তু ভোটের মৌসুমে মেইন স্ট্রিমে থাকার বাসনায় নির্বাচনের মাঠে ভোট নষ্ট করতে চায় না তারা। দুই দলের বাইরে সৎ এবং যোগ্য প্রার্থী থাকলেও মানুষ তাকে ভোট দিতে চায় না। কারণ হিসেবে বলা হয়, ওই ভালো লোকটি জিতবেন না, তাই খামাখা ভোটটা নষ্ট করবে কেন? এভাবে নষ্টরাই জেতে। তারা নষ্ট করে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো। সর্বোপরি বরবাদ করে দেশের সম্মান। এভাবে নষ্ট এবং ধ্বংসের দিকে ধাবমান আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সকল সম্ভাবনা।
ভোট নষ্ট না করার ছুতোয় নষ্ট রাজনীতির এ জয়জয়কারে চালাক-চতুররাও শরিক। লেখক-সাংবাদিকরাও এ পালের বাইরে নয়। কেউ শেখ হাসিনার চেয়েও বেশি আওয়ামী লীগ। কেউ বেগম খালেদা জিয়ার চেয়েও বিএনপিতে অন্তঃপ্রাণ। কিন্তু গুরুচরণ দশা পেশাদার, সাহসী ও উচিত কথার লেখক সাংবাদিকদের।
কারো লেখায় আওয়ামী লীগের কোনো ভুল-ত্রুটি এলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে যান রাজাকার। বিএনপির কোনো সমালোচনা করলে ভারতের দালাল। বামদের কোনো সমালোচনা করলে সিআইএর এজেন্ট। জামায়াতের বিরোধিতা করলে নাস্তিক। হেফাজত নিয়ে হককথা লিখলে মুরতাদ। ভারতের মৃদু সমালোচনা করলেও মুসলিম মৌলবাদী। লেখা পাকিস্তানের বিপক্ষে গেলে ভারতের দালাল- হিন্দুত্ববাদী। আমেরিকার কোনো সমালোচনা করলে গণতন্ত্রবিরোধী। চীন-রাশিয়ার সমালোচনা করলে প্রগতিবিরোধী। সুন্দরবন রক্ষার কথা বললে উন্নয়নবিরোধী। সুবিধাভোগী দালালদের ক্রিয়াকলাপ তুলে ধরলে ঈর্ষাকাতর। নারী মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বললে মেল শভিনিস্ট পিগ। পুরুষতন্ত্রের নোংরা দিক নিয়ে কথা বললে নারীবাদী। তাহলে কী করবে, কোথায় যাবে লেখক-সাংবাদিকরা?
কী-ও করা যাবে না। কী করাও মানা। হ্যাঁ আছে। এ জটিল অবস্থার মধ্যে করণীয় হিসেবে আগামী দিনগুলোতে বেশি বেশি করে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখাজোখা বাড়িয়ে দেওয়া যায়। তা-ও শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাতেও কিছু বিপত্তি থাকতে পারে। কোনটা শিশুদের উপযুক্ত, কোনটা অনুপযুক্ত সেই ঝামেলায় পড়ার ঝুঁকি থেকে বাঁচার পথ কম। সেখানেও যে রয়েছে হাল এবং পাল তোলার ব্যাপার। তা বুঝতে এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইয়ের ৯৭ পৃষ্ঠার কয়েকটি লাইনে নতুন করে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায়।
“এখানে একটা ঘটনার কথা না উল্লেখ করলে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের আসল চেহারাটা অনুধাবন করা যাবে না। বাহাত্তর সালের গোড়ার দিকে কুষ্টিয়ার কোর্টে জনৈক রাজাকারের বিরুদ্ধে একটি মামলার শুনানি হচ্ছিল। সাক্ষী-সাবুদ গ্রহণ আর জেরা শেষ হলে মাননীয় বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনমতো জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি দোষী না নির্দোষ।’ আসামি একদৃষ্টে মাননীয় হাকিমের দিকে নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে রয়েছে। মিনিট কয়েক পর আসামির মুখ থেকে জবাব এল, ‘আমি ভাবতাছি।’ জনৈক উকিল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, ‘কী ভাবতাছস?’ এবার আসামি জবাব দিল, ‘আমি ভাবতাছি আমারে যে সাবে এই রাস্তায় আনছিল, সেই সাবই তো হাকিমের চেয়ারে বইসা রইছে। তাহলে এইটা কেমন বিচার যে, হেই সাবে আজ প্রমোশন পাইয়া হাকিম আর হইলাম আসামি?’ ঠিকই- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই মাননীয় বিচারক মহোদয় ছিলেন কুষ্টিয়ার এডিসি (রাজাকার রিক্রুটমেন্ট), আর এরই প্রচেষ্টায় এই আসামি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। নিয়তির পরিহাস। সেদিনের গ্রামের সেই সাধারণ মানুষটা এখন আসামির কাঠগড়ায় আর এডিসি মহোদয় প্রমোশন পেয়ে বিচারকের আসনে বসে আছেন। এটাই ছিল সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণে অপারগ বাংলাদেশের চেহারা।”
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন