রম্য: মেনন-ইনুর বিনোদন

মোস্তফা কামাল

মন্ত্রিত্ব খোয়ানোর পর জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু স্ট্রোক করেছেন বলে খবর রটেছে গণমাধ্যমে। গণমাধ্যমের অন্যতম আলোচিত খবর এটি। কারও কাছে এটি হাস্যকর খবর। ঘঁষা আলাপের বিষয়। আশপাশে নানান কথা বললেও প্রকাশ্যে তিনি এখনো নিজের বেদনা-ক্ষোভের কথা জানাননি। সরকারের বিরুদ্ধেও কিছু বলেননি। একসময় তেঁতুল হুজুর বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলা ইনুর জায়গায়ই বসানো হয়েছে তেঁতুল হুজুরের ভাগনে নামে কথিত ড. হাছান মাহমুদকে। মন্ত্রিত্ব হারানোর চেয়েও এটি বেশি কষ্টের। এ কষ্ট তাকে হজম করতেই হচ্ছে। তবে, কষ্টের কথা গোপন রাখতে পারেননি সরকারের আরেক পার্টনার সাবেক মন্ত্রী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। প্রকাশ্যে এমনকি সংসদেও জানিয়েছেন তার ক্ষোভের কথা।
মন্ত্রিত্ব থাকার সময়ও ক্ষমতাসীন দলের কারও কারও কথা-কাজে আক্রান্ত হয়েছিলেন ইনু। তখন একবার তিনি এক আনা-দুই আনা মিলিয়ে ষোলো আনায় সরকার গঠনের সবক দিয়েছিলেন। বোঝাতে চেয়েছিলেন, তাদের ছাড়া আওয়ামী লীগের সরকার গঠন সম্ভব ছিল না। তার সেই বড়াই এবার মাঠে মারা গেছে। অন্যদিকে মেনন এ ধরনের কোনো অহমবোধ দেখাননি। কিন্তু বাদ পড়ার ক্ষোভও চাপিয়ে রাখতে পারেননি। কথার সুযোগ পেলেই দু-চার কথা শোনান সরকারকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভেনেজুয়েলার পরিণতির ভয়ও দেখিয়েছেন। তার ভাষায় : ভেনেজুয়েলায় যেভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা বাংলাদেশেও হতে পারে। জনগণের সমর্থন না থাকলে সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারের বর্ম হতে পারে না। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা মেননের ক্ষোভে মিটিমিটি হাসেন। মন্ত্রিত্ব না হোক, সংসদীয় কমিটির একটি চেয়ারম্যান বা লাভজনক পদ দিলেই তিনি শুকরিয়া জানিয়ে চুপসে যাবেন বলে নিশ্চিত তারা।
এদিকে সরকারের ওপর চটেছে ইনুর বিপরীত জাসদও। ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মতো অভিযোগ ছুড়েছে ১৪ দলের শরিক সরকারের এই পার্টনারও। জাসদ-আম্বিয়া নামের এ দল থেকেও একজন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি এবং টিআইবির পর রাতে ব্যালট বাক্স ভরার অভিযোগ তাদেরও। দলটির পক্ষ থেকে এই মর্মে একটি রেজ্যুলুশন গ্রহণ করা হয়েছে।
‘প্রশাসনের অতি উৎসাহী অংশ নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে’ শিরোনামের রেজ্যুলুশনটিতে নির্বাচন প্রসঙ্গে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। সাম্প্রতিক নির্বাচন প্রসঙ্গে শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে, তা সবাই জানেন। সবাই বুঝতে পেরেছেন ঘটনাটি কী হয়েছে। এটি প্রমাণ করার কিছু নেই। মানুষের কাছে এতই স্পষ্ট হয়েছে যে কোথায় কত কম অনিয়ম হয়েছে বা কোথায় অনিয়ম হয়নি, সেটিই খুঁজে দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার পুরোপুরি একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হয়েছে। প্রশাসনের লোকেরা এর সঙ্গে জড়িত ছিল।
কিন্তু আপনারা তো মহাজোটের অংশ হিসেবেই নির্বাচন করেছেন?-এ প্রশ্নের উত্তরে জাসদ নেতার মন্তব্য : এ রকম নির্বাচন হবে তা তো আমরা আগে বুঝতে পারিনি। সমাজের ভেতর থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলেও অভিমত তার। ১০ বছর ক্ষমতার অংশীদার থেকে অর্জন কী হলো, ১৪ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত বাম দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। এই প্রশ্নের উত্তর নানা রকম। স্থূল যুক্তির কর্মীরা বলছে, ইনু-মেনন-দিলীপ বড়ুয়ারা মন্ত্রী হয়েছিলেন, এমপি হয়েছিলেন তারাসহ আরও কয়েকজন, নিজেদের দলীয় কিছু কর্মীকে চাকরিতে বা উচ্চপদে বসাতে পেরেছেন, কাউকে কাউকে ব্যবসার সুযোগ করে দিতে পেরেছেন ইত্যাদি।
ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় যা তারা পারেননি। ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সেই সুযোগটা তো তারা ব্যবহার করতে পারতেন। নিজেদের পার্টির বক্তব্য নিয়ে যেতে পারতেন মানুষের কাছে। গতি আনতে পারতেন সহযোগী গণসংগঠনগুলোতে। ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন শক্তিশালী করার সুযোগ ছিল তাদের। কিন্তু সেদিকে তাদের মনোযোগ ছিল না। এত দিন সরকারে থেকেও জাতীয় রাজনীতিতে বা এলাকায় সাংগঠনিক দৈন্যদশা একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে। দলের শক্তি বৃদ্ধি এবং প্রদর্শন করা গেলে জোটের মুরব্বি আওয়ামী লীগের কাছে বামদের ওজন বাড়ত। শেখ হাসিনার একক দয়ায় যারা মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন, তারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে সৃজনশীলতাও দেখাতে পারেননি। এমপিরা সংসদের ফাঁকা মাঠেও এমন কোনো বক্তব্য বা যুক্তি উত্থাপন করতে পারেননি, যা মানুষ মনে রাখতে পারত। তারা পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে পারেননি, সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপক্ষে কোনো যুক্তি-তর্ক তুলে ধরতে পারেননি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে গতি সঞ্চার করাতে পারেননি। সব সময় কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচিয়ে গেছেন বিএনপি-জামায়াত ঠেকাও বলে। তবে শেখ হাসিনার বন্দনায় তারা সফল হয়েছেন। কখনো কখনো পেছনে ফেলতে পেরেছেন আওয়ামী লীগের নেতাদেরও। নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন সবাই। তা নিয়ে অভিমান দেখাচ্ছেনও নির্লজ্জভাবে। তাদের মন্ত্রিত্ব করা দেখেও দেশের মানুষ হেসেছে। এখনকার অভিমান দেখেও হাসছে।
অথচ শক্তিতে কমজুরি হলেও তাদের প্রতি মানুষের ভিন্ন রকমের ধারণা ছিল। ইনু-মেনন-দিলীপ বড়ুয়াদের কল্যাণে সেটাও কৌতুকে পরিণত হয়ে মাঠে মারা গেছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বামদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়ে উপকারই করেছেন। কিন্তু উপকারীর উপকার স্বীকার না করে দেখাচ্ছেন ভয়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন