নিজস্ব প্রতিনিধি : আইনগত প্রক্রিয়ায় বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্য নির্ধারিত হলেও দেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে আঁধার যেন আরও ঘনীভূত হয়েছে। নির্বাচনের জন্য সরকারি দল প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম গুছিয়ে আনছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ১৪ দল ও মহাজোটের শরিকরাও নির্বাচন নিয়ে এতটা তৎপরতা দেখাচ্ছেন না। তাদের মুখ্য প্রতিপক্ষ বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এখনো প্রাথমিক প্রস্তুতিমূলক কাজও সম্পাদন করতে পারেনি। মূল নেত্রীকে জেলে রেখে এবং শীর্ষস্থানীয় অপর অধিকাংশ নেতাকে দুদক আর পুলিশি গ্রেফতার আতঙ্কে রেখে সরকারি দল একতরফাভাবেই নির্বাচনী কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু করেছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটলেও সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়টি বড় হয়ে আসবে।
সরকার সারা দেশে একটা নির্বাচনী আবহ তৈরির চেষ্টা করছে। সরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রটোকল, প্রোটেকশন নিয়ে দলীয় জনসভা করে সেখানে মানুষকে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। এ নিয়ে বিএনপি থেকে প্রশ্ন তোলা হলেও এই নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হয়নি। শেখ হাসিনা বলেছেন, দলের প্রধান হিসেবে আমি ভোট চাইতেই পারি। এতে অন্যায়ের কী আছে? কথাটা অন্যায়, অযৌক্তিক নয়। কিন্তু কথা উঠেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে সরকারি প্রটোকল ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় উপস্থিতি ও দলের পক্ষে ভোট চাওয়া নিয়ে। তফসিল ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে তিনি তা করতে পারবেন না। দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার দলীয় ও সরকারি এই তৎপরতার পরও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো আগ্রহ-উদ্দীপনা এখনো লক্ষণীয় নয়। সব দলের, বিশেষ করে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকার ফলেই মানুষের মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে সরকার জনমনে নির্বাচনী আবহ, আমেজ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। একই উদ্দেশ্যে সরকার দ্বিতীয় ধাপে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাবে। তবে তা নির্ভর করবে হস্তক্ষেপ ও প্রভাবমুক্ত, অবাধ, নিরপেক্ষতার সঙ্গে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনমত পক্ষে রাখতে এই দুই করপোরেশন নির্বাচন প্রশ্নহীনভাবে অনুষ্ঠান করবে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন। সরকারও এই নির্বাচনকে পরীক্ষা হিসেবে নিচ্ছে। এতে প্রত্যাশিত ফল না হলে অপর তিন সিটি করপোরেশন ও পরবর্তী সংসদ নির্বাচন নিয়েও সংশোধিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মপরিকল্পনা নেবে। সরকারের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করছে বলেই প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পার্টির প্রধান এইচ এম এরশাদকে সংসদ ভবনে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে প্রার্থী না দেওয়ার জন্য বলেন। ভবিষ্যতের আশায় এবং সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে এরশাদ তাতে সম্মত। কিন্তু বিএনপিকে নির্বাচনে রাজি করানো সরকারের জন্য বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না এলে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে নির্বিঘেœ দেশ পরিচালনা সরকারের জন্য বর্তমান সময়ের মতো সহজসাধ্য না-ও হতে পারে। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে। বিএনপি নির্বাচনে না এলে তাকে নির্বাচনে আনা সরকারের দায়িত্ব নয় বলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হলেও তাদের ভেতরের কথা তা নয়। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারা মনে করেন, বিএনপির কর্মীদের হতাশ করতেই এ পর্যায়ে এ কথা বলা হয়েছে।
সরকার ঢাকাসহ দেশের কোথাও নানা অজুহাতে বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়া এবং খালেদা জিয়াকে জেলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না দেওয়ায় খালেদা জিয়া ও বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়িয়েছে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরা সরকারি বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে কর্মসূচি সফল করতে না পারার পাশাপাশি কোটা সংস্কারের মতো অরাজনৈতিক দাবিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সারা দেশে দ্রুত তার বিস্তার লাভের ঘটনা সরকারি দলের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে। এই আন্দোলন সামনে আরো তীব্র আকারে দেখা যেতে পারে। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ও সামনে চলে আসতে পারে। দেশি-বিদেশি মহল বিশেষ অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটনারও মদদ দিতে পারে, যা এক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতেই ভূমিকা রাখবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশন গঠিত হয়েছে সরকারে বিশ্বস্তজনদের সমন্বয়ে। সিইসি ও ইসির কোনো কোনো সদস্য বিভিন্ন সময়ে এমন সব কথাও বলেছেন, যা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। নিতান্ত বিএনপিকে খুশি করার জন্য সিইসি ও কোনো কোনো কমিশনার মন্তব্য করেছেন বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন না। তারা এসবের মধ্যে ভিন্ন কিছু গন্ধও খুঁজে পাচ্ছেন না। নির্বাচনের একটা পর্যায়ে বর্তমান সিইসি ও কোনো কোনো কমিশনার নির্বাচন অনুষ্ঠানে অসামর্থ্যতা প্রকাশ করে পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে? সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এ ভাবনা দুশ্চিন্তা হয়ে কাজ করছে। তফসিল ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান পদে থাকলেও সরকার অনেক দুর্বল অবস্থায় থাকবে। কেন্দ্রীয় ও মাঠ প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন নিয়ে সরকারের মধ্যে দুর্ভাবনা না থাকলেও তফসিল ঘোষণার পর তাদের এই রূপে না-ও দেখা যেতে পারে। নির্বাচনে কোনোভাবে হস্তক্ষেপ, প্রভাব সৃষ্টি, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তারা সহায়ক না-ও হতে পারেন। অবাধ, নিরপেক্ষ ভোট হলে আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারবে না, এখনই এ ধারণা মানুষের মধ্যে দৃঢ়ভাবেই রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে তা আরো প্রবল হতে পারে। জনমানুষের সরকারবিরোধী এই মনোভাবকে এড়িয়ে তাদের ৫ জানুয়ারির মতো নিষ্ক্রিয় সরকারের সহায়কের ভূমিকায় না-ও দেখা যেতে পারে। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বিধান্বিত মনোভাব প্রকটভাবেই ফুটে উঠছে।