রাজনীতি আছে রাজনীতি নেই!

সেলিম আহমেদ : বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রবল ঢেউ চলছে বাংলাদেশেও। দেশের রাজনীতির মাঠ এখন ফাঁকা। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ছাড়া খুব একটা মাঠে রাজনীতি আছে রাজনীতি নেই অন্যরা। খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি ও অসুস্থতার খবরও মানুষকে খুব একটা টানে না। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে, ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছে আপন জগতে। নিজে ভালো থাকলেই হলোÑ এ নীতিতে যেন হাঁটছে সবাই। চারপাশে কী হচ্ছেÑ এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই কারো। এই করোনাকালেও একদিকে যেমন এগিয়ে চলেছে উন্নয়নকাজ, অন্যদিকে সম্প্রতি খুন-ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের একাধিক বড় ঘটনা মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক নেতারা যার যার দল আর নেতাদের পক্ষে বলে যাচ্ছেন অনর্গল। তাই ‘সুখের জয়গানের’ পাশাপাশি ‘অসুখের সুর’ অনেকটা ধন্দে ফেলে দিয়েছে দেশবাসীকে।
অপরদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের রাজনীতি এখন অনেকটা ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। আর রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছানোয়। দেশ ও জনগণকে নিয়ে চিন্তা করার সময় এখন তাদের নেই।
এ প্রসঙ্গে সমাজ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বাস্তবতা হলো রাজনীতি নিজেই একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সংসদে যারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। ৬১ শতাংশ এমপি ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী মানে তারা ঘোষিতভাবেই ব্যবসায়ী। বাকিরাও ব্যবসায়ীকে সাহায্য করেন। তারা প্রকাশ্যে না হলেও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ক্রমাগত ব্যবসায়ীদের অধীনে চলে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিকল্প কিছুর প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে রাজনীতিকে সামাজিক করা। এটা এখন যারা রাজনীতি করছেন তারা করতে পারবেন না। বাস্তবতা বলছে, রাজনীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। এভাবে চলতে পারে না।’
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মত, রাজনীতিহীন একটা রাষ্ট্র হলো রক্তশূন্য মানুষের মতো। বাংলাদেশ কি ক্রমশ রক্তশূন্য হয়ে পড়ছে? রাজনীতিহীন একটি রাষ্ট্র বিপজ্জনক। দেশের এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতাদের যতখানি সক্রিয় থাকার প্রয়োজন ছিল সেটি তারা করে দেখাতে পারেননি। ক্ষমতাসীনদের অনেকে ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে। আর বিএনপি তো এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটি দল। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অতি অনাকাক্সিক্ষত ভরাডুবির পর তাদের নেতা খালেদা জিয়াকে পাঠানো হয়েছে জেলে। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে ‘সাজা স্থগিতের’ পর যদিও তিনি এখন মুক্ত, তবে প্রকারান্তরে আসলে তিনি ‘গৃহবন্দী’। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। সোজাসাপ্টা বলা যায়, দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই। না সরকারি দলে, না বিরোধী দলে। রাজনীতিশূন্য দেশে তাই ভোটের দিনেও কোনো উৎসব হয় না। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোও অনেকটা ভোটারবিমুখ। একটা দেশে যখন রাজনীতি থাকে না, তখন দেশ চলে যায় আমলা আর প্রশাসনের হাতে। অন্যদিকে বাম রাজনীতিবিদরা বছরজুড়ে নানা জন-ইস্যুতে মাঠে থাকলেও তারাও কাছে টানতে পারছে না সাধারণ মানুষকে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনীতির প্রথম শর্ত হচ্ছে ক্ষমতার জন্য লড়াই। ক্ষমতার লড়াই করতে গিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি, পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলছি। আমরা মনে করি, ক্ষমতায় গেলে আমার মতাদর্শ মানুষের মাঝে প্রয়োগ করতে পারব। এ থেকেই দ্বন্দ্বের শুরু। প্রথমেই আসি সামরিক শাসন প্রসঙ্গে। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম সামরিক শাসন এলো। এর পর থেকে কিছু লোককে রাজনীতিবিদ বানানোর দরকার হয়ে পড়লো। তাদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা, আশীর্বাদ বণ্টন করলো রাষ্ট্র। যারা পরাজিত মতাদর্শের লোক তাদেরও এনে পুনস্থাপিত করা হলো রাজনীতিতে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাত ছিল, হানাহানি ছিল, গণবাহিনী-রক্ষীবাহিনী ছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড বামপন্থীরা বাংলাদেশকেও শিকার করেনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগ পর্যন্ত। কিন্তু তখনো রাজনীতি বলতে মানুষের উপকার করা, কল্যাণ করার শুভবোধ ছিল। আমি মনে করি, এই ধারায়ও প্রথম বাদ সাধল সামরিক শাসন। এটার মধ্য দিয়ে রাজনীতির চরিত্র নষ্ট করা এবং মতাদর্শিকভাবে যে পরাজিত শক্তি তাদের পুনঃস্থাপিত করা এবং কিছু নতুন লোককে রাজনীতির মাঠে ঢোকানো হয়েছে। এই জায়গা থেকেই রাজনীতির অধঃপতনের সূচনা হয়েছে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১৫ বছর পর ১৯৯১ সালে যখন নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনে জয়ী দল বিএনপিতে দেখা গেল, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আমলা ও ব্যবসায়ীদের এমপি বানানো হয়েছে। প্রায় কাছাকাছি বিষয় দেখা যায় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও। ১৯৯১-৯৬ সালের পর এটা নিয়ে আর কথা বলা অবান্তর মনে হয়। দেখা যায়, যারা প্রফেশনাল রজানীতিবিদ তারা নানাভাবে কোণঠাসা হয়ে গেছেন। আবার অনেকে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। কারণ চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে, একজন ৪০ বছর রাজনীতি করলেন কিন্তু মনোনয়ন পাচ্ছেন গতকাল অবসর নেয়া আমলা কিংবা গত পরশু অবসর নেয়া সেনা কর্মকর্তা অথবা বড় কোনো ব্যবসায়ী। তারপরও কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা মানুষের জন্য কাজ করার কথা ভাবেন। কতটুকু করতে পারেন আমি নিশ্চিত নই। তবে এই সংখ্যা খুবই কম।’
দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভালোভাবেই চলছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় একথা বলে আসছে যে, বাংলাদেশে কোনো রাজনীতি নেই। তারা যে এসব কথা বলেনÑ এটাই রাজনীতি, এটাই গণতন্ত্র। বিএনপির দেশবিরোধী কার্যকলাপের জন্য জনগণ তাদের পক্ষে নেই। আমাদের বিরুদ্ধে এমন মনগড়া অভিযোগ করলে হবে না। আমি মনে করি বাংলাদেশে সব সময় রাজনীতি ছিল, বর্তমানেও আছে। আমি বলব, গত ছয় থেকে আট মাসে রাজনীতি আরও বেশি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনার সময় আমরা জনসম্পৃক্ততার রাজনীতি করেছি। তবে সাংগঠনিক রাজনীতি কিছুটা কম হয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘রাজনীতি থাকলে দেশের গণতন্ত্র থাকে। দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। একটা ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। বিরোধী মত বা ভিন্ন মত প্রকাশ করতে না দেয়াই হচ্ছে ফ্যাসিবাদী চরিত্র।’ সে কারণে দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আগে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদদের টাকা দিতেন রাজনীতি করার জন্য। এখন রাতারাতি রাজনীতিবিদ বনে যাওয়ার জন্য নিজেরাই টাকা খরচ করেন। দেশে এখন দুই ধরনের রাজনীতি বিরাজ করছে। হালুয়া-রুটির রাজনীতি আর আদর্শের রাজনীতি।’ তিনি বলেন, ‘লুটেরাদের হাতে রাজনীতি এখন জিম্মি। লোকে বলে, বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হলো এমপিগিরি। আমরা অনেক আগেই বলেছি এখন রাজনীতি নেই। রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ী ও টাকাওয়ালাদের হাতে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে রাজনীতির ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।’
বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, পুলিশ যে বাধা দেয় সেটাই হচ্ছে রাজনীতি। আমি নারায়ণগঞ্জে গিয়েছি সমাবেশ করতে। সেখানে পুলিশ লাঠিচার্জ করে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে সমাবেশ পণ্ড করে দেয় এবং আহত করে আমিসহ সবাইকে। তাই সরকারই রাজনীতি করে পুলিশের মাধ্যমে। আর বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে দেয় না। এটা কখনো সত্যি নয় যে, দেশে রাজনীতি নেই।