রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে নাক গলাচ্ছে বিদেশিরা

নিজস্ব প্রতিনিধি : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর আগে থেকেই এবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। মাঠে অবস্থানের সঙ্গে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো কূটনৈতিক তৎপরতাও বৃদ্ধি করেছে। সরকারবিরোধী সাত-আটটি দলের কয়েক ডজন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মিশন নিয়ে কাজ করছেন দেশ-বিদেশে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, জাতিসংঘ বাংলাদেশের ভোট ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আগামী নির্বাচন তারা সব দলের অংশগ্রহণে দেখতে চেয়েছে। স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবিও তুলেছে। বাংলাদেশের ভোট নিয়ে, মানবাধিকার নিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রকাশ্যে কথা বলাকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের জন্য অশুভ ইঙ্গিত বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, প্রতিটি দেশেই কিছু গোপনীয়তার বিষয় থাকে, তা কূটনৈতিক মহলে যাওয়া উচিত নয়। তাদের মতে, দেশের রাজনীতিতে বিভক্তি দেখা দেওয়ার কারণেই মূলত বিদেশিরা নাক গলানোর সুযোগ পেয়েছে। বিদেশিদের নানা বক্তব্য দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
দেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তত বেশি বিদেশি দূতাবাসকেন্দ্রিক হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতি এখন দূতাবাসমুখী। গত ১৪ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত কানাডিয়ান হাইকমিশনার লিলি নিকোলাসের সঙ্গে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ১৫ নভেম্বর নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন রিকটার ভেন্ডসেন এবং সুইডিশ রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্স বার্গ ফন লিন্ডের সঙ্গেও বিএনপির বৈঠক হয়। এ ছাড়া গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এবং ৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসনের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। এর আগে গত ১৩ জুলাই ইইউ রাষ্ট্রদূত এবং ১২ জুলাই জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাও রুটিন করে এখন দূতবাসের দরবারগুলোতে নিয়মিত সাক্ষাৎ করছেন। এসব বৈঠকের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের রাজনীতির মাঠে।
বিদেশিরা সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি এমন কিছু মন্তব্য করছেন, যা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে। অনেকে বিদেশিদের এমন হস্তক্ষেপকে দেশের জন্য অশুভ লক্ষণ বলে মনে করছেন। যেমন অতি সম্প্রতি ঢাকাস্থ জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছেন, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোথাও শুনিনি। আমরা বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে এবং বিরোধীরাও এতে অংশ নেবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করছি। আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না। বাংলাদেশে এখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার। এদিকে দেশে জীবনের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন চায় কানাডা। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলাসের সঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিষয়টি উঠে এসেছে।
এ ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ সবার জন্য কোনো রকম ভয়ভীতি-দমন ছাড়া শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস জানিয়েছেন, সম্প্রতি রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এটি উদ্বেগের। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আক্তার জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে অবাধ ও স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন চাওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ তিনটি রাজনৈতিক দল ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ বার্তাই জোরালোভাবে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টার, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি গত ২৪ জুলাই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক নিয়ে জার্মানির রাষ্ট্রদূত বলেন, স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কূটনীতিকদের প্রধান দায়িত্ব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদেশিরা কোনোভাবেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বক্তব্য দিতে পারে না। তাদের নিজস্ব একটি সীমানা রয়েছে। দেশীয় বিষয়গুলো দেশের নাগরিকেরা ঠিক করবে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্তির সুযোগ নিয়ে বিদেশিরা যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। আর বিদেশিরা তখনই কথা বলে, যখন তাদের হাতে কোনো শক্ত ডকুমেন্ট থাকে।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের দেশীয় বিষয়ে কোনোভাবেই বিদেশিদের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয় দেশের জনগণই ঠিক করবে। অনেকেই বাংলাদেশের মানবাধিকার ও নির্বাচন বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই এ বিষয়গুলোর ব্যত্যয় ঘটে, সেটির সমাধান নিজ নিজ দেশই সমাধান করে। বাংলাদেশেও তা-ই হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, কূটনৈতিক বিষয়ে প্রতিটি দেশে কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় রয়েছে। সেগুলোতে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ বিষয়গুলো তখনই ঘটে, যখন রাজনৈতিক বিভক্তি দেখা দেয়। তখন কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কিছু গোপন বিষয় বিদেশিদের জানিয়ে দেন। এটি খুবই অশুভ লক্ষণ।