রাতের আঁধারে পরিবার থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে শিশুদের

ট্রাম্প প্রশাসনের নিষ্ঠুরতা

ঠিকানা ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে গত কয়েক সপ্তাহে কয়েকশ অভিবাসী শিশুকে রাতের আধাঁরে কানসাস থেকে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পিঠে একটি ব্যাকপ্যাক, হাতে হাল্কা খাবার নিয়ে বাসে তোলা হয় শিশুদের। এক অঙ্গরাজ্য থেকে আরেকটি অঙ্গরাজ্যে যাত্রার জন্য তাদের প্রস্তুতি নিতে খুব কম সময় দেওয়া হয়েছে। কানসাস ও নিউ ইয়র্ক থেকে এসব শিশুরা যাবে পশ্চিম টেক্সাসের মরু এলাকায়। যেখানে রয়েছে তাদের জন্য একটি তাঁবুর শহর। সেখানে যাওয়ার পর তাদেরকে ছেলেমেয়ে ভেদে ২০ জন করে আলাদা করা হয়, লাইন ধরে ঘুমায় তারা। কোনও স্কুল নেই, আছে বই-খাতা। কিন্তু পড়ালেখার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
এই বিবরণটি পড়ার পর মনে হতে পারে স্কুলের শিশুদের নিয়ে আনন্দ ভ্রমণ বা শিক্ষা সফরের কথা মনে হতে পারে। কিন্তু এই ঘটনাটি তেমন কিছু না। এভাবেই রাতের আঁধারে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে পরিবার বিচ্ছিন্ন অভিবাসী শিশুদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে টর্নিলোতে। যেখানে নেই পর্যাপ্ত সুবিধা। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এটা ঘটছে পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়েই। কারণ ট্রাম্প প্রশাসন ১৩ হাজারের বেশি অভিবাসী শিশুকে আশ্রয় দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
টর্নিলোতে তাঁবু দিয়ে নির্মিত অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরটি একটি ছোটখাটো শহরের মতোই। মেক্সিকো সীমান্তবর্তী এই ক্যাম্পে রয়েছে ভ্রাম্যমাণ টয়লেট, বিভিন্ন আকারের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু, বিনোদন ও চিকিৎসা কেন্দ্র। জুনে ৪০০ জন মানুষের জন্য মাত্র ৩০ দিনের জন্য এই আশ্রয় শিবিরটি খোলা হয়েছিল, সেপ্টেম্বরে এর আকার বড় করা হয় যাতে করে ৩ হাজার ৮০০ মানুষ এখানে বসবাস করতে পারে। অস্থায়ী হলেও এই বছর শিবির থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
টর্নিলোর তাঁবু শহরের ব্যবস্থাপনা অন্যান্য স্বাভাবিক অভিবাসী শিশুকেন্দ্রের মতো নয়। অভিবাসী শিশুকেন্দ্রগুলোতে যেমন স্কুল সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, টর্নিলোতে সেই ব্যবস্থা নেই।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে অভিবাসী শিশুদের নিয়ে কাজ করা মার্ক গ্রিনবার্গ জরুরি আশ্রয় নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন। তিনি বলেন, সংস্থাটি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে যেন টর্নিলোতে স্বাভাবিক আশ্রয়কেন্দ্রর মতো সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। তবে কিছুক্ষেত্রে সেটা খুবই কঠিন ও অসম্ভব।
আশ্রয় শিবিরের কয়েকজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিশুদের রাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কারণ এতে করে তারা পালানোর সুযোগ পাবে না। তাদের ধারণা, দিনের বেলাতে শিশুদের স্থানান্তর করা হলে তারা পালানোর চেষ্টা করতে পারে। একই কারণে তাদেরকে জানানোও হচ্ছে না কখন ও কবে স্থানান্তর করা হবে। এক কর্মী বলেন, মিডওয়েস্ট থেকে টর্নিলো স্থানান্তরের কয়েক ঘণ্টা আগে শিশুদের জানানো হয়েছিল। তাদের ধারণা আগে জানালে শিশুরা ভয় পেয়ে যেত এবং পালানোর চেষ্টা করত।
স্থানান্তরের সময় শিশুরা একটি বেল্ট পরে থাকে যেখানে কলম ও জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যাবে এমন কারও নম্বর থাকে। এক কর্মীকে এক শিশু জিজ্ঞাসা করেছিল যে টর্নিলোতে তার খেয়াল রাখা হবে কি না। তাকে বলা হয় যে সে সেখানে ভালো থাকবে। আর আশ্রয় কেন্দ্রে তার জায়গায় সীমান্তে আটকে পড়া অন্যান্য শিশুদের আশ্রয় হবে।
ওই আশ্রয় কর্মী বলেন, শিশুরা চলে যাওয়ার সময় কর্মীরা কাঁদছিল। তাদের কাছে শিশুরা যেমন যতেœ ছিলেন, নতুন জায়গায় তেমনটা থাকবেন কি না সেটা নিয় শঙ্কা ছিল। বেশ কয়েকজন এর প্রতিবাদও করেছিলেন। তবে ম্যানেজার তাদের বোঝান যে এত মানুষকে সামাল দেওয়ার জন্য অনেক সময় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
স্বল্প স্থানে এতো বেশি শিশুকে রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে মার্কিন স্বাস্থ্য ও মানবিক সেবা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এভলিন স্টফার বলেন, এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য যে আশ্রয় শিবিরে অনেক মানুষ থাকছে। সামরিক ঘাঁটিগুলোতেও এমনটা দেখা গেছে। তাই এই অস্থায়ী আশ্রয় শিবির যতদিন প্রয়োজন ব্যবহার করা হবে।
মার্কিন স্বাস্থ্য ও মানবিক সেবা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর অভিবাসী শিশুর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। সরকারি হেফাজতেও অনেক সময় কাটাতে হচ্ছে তাদের। আগে যেখানে তাদের ৩৪ দিন সরকারি হেফাজতে থাকতে হতো, এখন থাকতে হয় ৫৯ দিন।
গত মে মাস থেকে আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে ৯০ শতাংশের বেশি জায়গায় পূরণ হয়ে যাওয়ায় নতুন আবাসনের চিন্তা করা হচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়া খুবই দ্রুতগতিতে আগাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে শত শত শিশুকে ওয়েস্ট টেক্সাসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত স্থানান্তর করা হয়েছে ১৬০০ জনেরও বেশি।
স্টফার বলেন, তাঁবু দিয়ে শিশুদের জন্য শহর তৈরির বিষয়টি আদতে আমাদের অভিবাসন ব্যবস্থার দুর্বলতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে। অভিবাসন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পরিবার ও বিচ্ছিন্ন শিশুদের সংখ্যা মূলত এই সমস্যার আকারেই প্রতিফলন। তিনি বলেন, বয়স ও দুর্বিষহ ভ্রমণের কারণে বিচ্ছিন্ন এই শিশুগুলো নিপীড়ন ও পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে। এজন্য মন্ত্রণালয় প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন জানিয়েছে যেন দ্রুত এই ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়।
তবে এত বিশাল সংখ্যক শিশুদের স্থানান্তরের বিষয়টিতে উদ্বিগ্ন অভিবাসন আইনজীবীরা। ইতোমধ্যে শিশুদের এতদিন পরিবার বিচ্ছিন্ন রেখে পুলিশি হেফাজতে রাখার বিষয়টিতে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আশ্রয় শিবিরের সর্বোচ্চ ১০০টি আশ্রয়ে নিবন্ধন রয়েছে ও সেগুলো শিশু সুরক্ষা কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। এই ক্যাম্পগুলোই শিশুদের নিরাপত্তা ও শিক্ষায় জোর দেয়। বিশেষ করে স্টাফদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও।
কর্মকর্তারা বলছেন, টেক্সাসে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টা অস্থায়ী। যারা খুব শিগগিরই মুক্তি পাবে তাদেরই সেখানে নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার। বিশেষ করে যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। খুব শিগগিরই হয়তো তারা স্পন্সর পেয়ে যাবে। তবে অভিবাসন অধিকারকর্মীরা জানান, এই অস্থায়ী ক্যাম্পের কয়েক মাস থাকতে হতে পারে শিশুদের।
উইমেন্স রিফিউজি কমিশন এর আইনজীবী লিহ চাভলা বলে, ‘অবশ্যই আমরা শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের যতটুকু যতœ প্রয়োজন ততটুকু পাবে কি না, শারীরিক ও মানসিক সেবা ও যতœ পাবে কি না সেটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’ তিনি বলেন, ‘এটা কোনও সমধান হতে পারে না। আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে যে শিশুরা কিভাবে স্পন্সরের মাধ্যম এই সরকারি হেফাজত থেকে ছাড়া পেতে পারে।’
আশ্রয় কর্মীরাও মনে করেন, শিশুরা যতদিন সরকারি হেফাজতে আটকে থাকে তত বেশি হতাশ হয়ে পড়বে। এতে করে তারা সহিংস হয়ে উঠতে পারে কিংবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। আর অধিকারকর্মীরা জানান, টর্নিলোর মতো বড় আশ্রয়কেন্দ্রে নির্দিষ্টভাবে শিশুদের সুযোগ-সুবিধা দেখাশোনার বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া সেখানে নিয়ে যাওয়ার আগে যথেষ্ট সময় না দেওয়ায় শিশুরা তাদের বন্ধুদের বিদায়ও জানাতে পারেনি। ইতোমধ্যে মানসিক চাপে থাকা শিশুদের ওপর এটা বিরুপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।
রাতের আঁধারে এভাবে শিশুদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস এক বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। তাতে পত্রিকাটি লিখেছে, শিশুদের মধ্যরাতে বিছানা থেকে তুলে, যাদের সঙ্গে তার একটু সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এবং আরও বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিলে যে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে– এই বিষয়টি অনুধাবনের জন্য মনোবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই নীতিকে ড্রাকনিয়ান আখ্যায়িত করে দ্রুত এর অবসান চাওয়া হয়েছে সম্পাদকীয়তে।