রাতের ছায়া

রুপা খানম

ছিঃ ছিঃ ছিঃ অবিবাহিত মেয়ে মা হতে চলেছে! সমাজে এসব কী চলছে। প্রতিবেশীদের যেন ঘুম হারাম হয়ে গেছে সেই চিন্তায়। কেউ কেউ আবার করছে কানাকানি। আমাদের সভ্য সমাজ বলতে কী আর রইল? তিন্নির বাবা-মাকে কথা শোনাতে ছাড়ছে না কেউই। কী করে এমন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে তিন্নির এই অবস্থা! ঘরে বড় মেয়ে রেখে বাবা-মা এমন করে বাইরে থাকে নাকি! আজ মধ্যবয়সী তিন্নি ভাবছে, এমনটি কেন হয়েছিল ওর সাথে!
২২ বছর আগের কথা। মা-বাবা ও তিন ভাইবোন নিয়ে তিন্নিদের পরিবার। চাকরির সুবাদে বাবাকে প্রাই দেশের বাইরে যেতে হতো। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় বোন অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। বড় বোনের বিয়ে হওয়ার পর সে তার স্বামীর সাথে চলে যায়। এক বছর পর বড় বোনের বাচ্চা হওয়ার সময় ডা. নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে তিন্নির মাকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যায়। বড় মেয়ের বাচ্চা হওয়ার সময় অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সে কারণে মাকে ভিজিট ভিসা পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি। ওখানে যাওয়ার তিন মাস পর ভিজিট ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় বোনের ইচ্ছায় স্থায়ীভাবে থাকার আবেদন করেন। মা চাইতেন না স্থায়ী হতে। ছোট ছেলেমেয়েদের দেশে রেখে বিদেশের মাটিতে কাগজের জন্য পড়ে থাকা মায়ের জন্য কষ্টকর ছিল। স্থায়ী হলে ছেলেকে আর এক মেয়েকে এ দেশে আনতে পারবেন, তাই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তিন্নি শিখে গেছে সবকিছু। মা যেভাবে সংসার চালাতেন। সংসারের সব কাজ সামলে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিল। তিন্নি এখন ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে পড়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিন্নি সবার ছোট। মা স্থায়ী বসবাসের জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে বছরের পর বছর পার হয়ে গেল। দেশে বাবার সাথে তিন্নি আর ভাই তপন থাকত। ভালোই চলছিল তাদের সংসার।
তিন্নির বাবার সাথে একসময় চাকরি করত তারই বন্ধুর ছেলে চয়ন। প্রায়ই তিন্নিদের বাসায় এসে উঠত। মাঝেমধ্যে কাজ থাকলে ঢাকায় আসত। এবার এসেছে আমেরিকায় যাওয়ার সব কাগজ তৈরি করতে। তিন দিন হয়ে গেছে বাবার বন্ধুর ছেলে চয়ন এসেছে তিন্নিদের বাসায়। এই পরিবারের সাথে সম্পর্ক মনে হয় রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি। একসময় তিন্নির বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, তখন তার এই বন্ধু তাকে সাহায্য করেছিলেন তাদের এই বাড়িটা তৈরির সময়।
তিন্নিদের বিশাল আভিজাত্যঘেরা এই বাড়িটি। এত বড় বাড়ি, ঘরে মা নেই। এতটুকু মেয়ে মেহমানদারি থেকে সবকিছু কত সুন্দর করে সামলে রাখতে শিখেছে। তা দেখে মায়ের মন বসে গেছে অস্ট্রেলিয়ায়। আগের মতো আর অস্থিরতা কাজ করে না ছেলে ও ছোট মেয়ের জন্য। নাতিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছেন বিদেশের মাটিতে।
ছয় বছর পর আজ তিন্নি পুরো গৃহিণী। আজ মাসের প্রথম দিন। মাসিক বাজার ঘরে এনেছে। তিন্নি সব কাজ গুছিয়ে রান্না করে সবাইকে রাতে খাওয়াতে বসে গেছে। রাত নয়টা। যথারীতি সবাই রাতের খাবার শেষ করে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবার বন্ধুর ছেলে চয়নও আজ তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে গেছে। তিন্নিও যথারীতি সব কাজ শেষ করে ঘুমাতে চলে এসেছে তার রুমে। রুমের বাতি বন্ধ করে সারা দিনের ক্লান্ত তিন্নি ঘুমে বিভোর।
রাত দুইটা। তিন্নি হঠাৎ উপলব্ধি করে, কেউ তার বেডরুমে অবস্থান করছে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই অদৃশ্য ওই লোক জোরপূর্বক তিন্নির মুখে রুমালচাপা দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে তিন্নির। কিন্তু কে মশারির নিচে ঢুকে তিন্নিকে জাপটে ধরেছিল কিছুই বুঝতে পারল না। এ কী ঘটে গেল তার জীবনে! কে তার সর্বনাশ করল! কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিন্নি ভাবছে বিষয়টি তার ভাইকে জানাবে। কিন্তু কী বলবে ভাইকে, বুঝতে পারছে না। মাথা কোনো কাজ করছে না তিন্নির।
তিন্নি বরাবরই একা তার রুমে ঘুমায়। আজও তা-ই করেছে। এমন তো কখনো হয়নি। সব রুম ছিল অন্ধকার। ঘুমের ঘোরে অবচেতন মনে চিনতেও পারেনি কে সে? মুখে রুমালচাপা দিয়ে তার পৃথিবী তছনছ করে দিয়ে গেছে! কোনোমতে উঠে তিন্নি বাইরের দরজা দিকে তাকাল। দরজাও বন্ধ! পাশের রুমে গিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল মেহমান চয়নকে। না, সে তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য তিন্নি স্তব্ধ। তাহলে তার এত বড় ক্ষতি কে করল, ভাবতে পারছে না। বাইরের দরজাও বন্ধ! ভয় ও যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল তিন্নি। কান্নার শব্দ শুনে তপন উঠে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তিন্নি? কাঁদছিস কেন, ভয় পেয়েছিস? তিন্নি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। কিছুই বলতে পারছে না। শরীর থরথর করে কাঁপছে। তপন জিজ্ঞাসা করেই চলছে, কী হয়েছে তিন্নি, বল আমাকে? তপন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিন্নি আবার জ্ঞান হারাল। এদিকে এত চেঁচামেচি, কান্না আর শব্দের মাঝেও চয়ন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এমনটা করতে করতে ভোর হয়ে এল। ভোর হওয়ার সাথে সাথেই তিন্নিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল তপন। ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা করার জন্য তিন্নিকে রুমে নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা শেষে তপনকে ডেকে বললেন, আপনার সাথে কথা আছে। আপনার বোনকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। হাসপাতাল দু-এক দিন থাকতে হবে। আপনার বোনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, কাল রাতে তার সাথে ঘটে গেছে বিভীষিকাময় এক ঘটনা। কাল রাতে তার রুমে কেউ ঢুকে তাকে অজ্ঞান করে ধর্ষণ করেছে। অন্ধকার ঘরে রুমালচাপা দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে কোনো দুর্বৃত্ত এমন অপকর্ম করেছে। আমরা কিছু পরীক্ষা করেছি, তার রেজাল্টে তা-ই পেয়েছি। আপনার বোন বলতে বলতে কিছুটা তাল হারিয়ে ফেলছিল। শুধু বলছিল, কাপড় দিয়ে ঢাকা একজন তাকে জাপটে ধরেছিল। তাকে চিনতে পারেনি। কে এমন করেছে, তাকে চিনতে না পারায় ভীষণ ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
ডাক্তার তপনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের বাড়িতে কে কে থাকে। তপন বলল, আমরা তিনজন থাকিÑআমি, বাবা আর আমার বোন তিন্নি। মা এখানে থাকেন না। তিনি বড় বোনের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। তিন দিন আগে একটি কাজে আমার বাবার বন্ধুর ছেলে আমাদের বাসায় এসেছে। সে এখন আমাদের বাসায়ই আছে। সে প্রায়ই আমাদের বাসায় আসে। আমরা রক্তের সম্পর্ক না হলেও অনেক আপন। ডাক্তার সাথে সাথে তিন্নির ভাইকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, বাইরে থেকে আর কেউ আসেনি আপনাদের বাসায়? তপন না-সূচক জবাব দিল। ডাক্তার বললেন, আমি নিশ্চিত, আপনার বোনের এত বড় সর্বনাশের জন্য দায়ী আপনার বাবার বন্ধুর ছেলেই। দ্রুত বাসায় গিয়ে তাকে ধরে পুলিশে দিন। আমি সব রিপোর্ট দিচ্ছি। ডাক্তারের কথা শুনে তপন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। তার সমস্ত শরীরে বইছে আগুনের বারুদ। ঘরে ছুটে গিয়ে দেখতে পায়, চয়ন বিষণ্ন মুখে মাথা নিচু করে বসে আছে। রাগে তপনের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। চয়নের কলার ধরে তাকে টেনেহিঁচড়ে গেটের বাইরে নিয়ে এসে বলে, আজ তোকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। রাগে থরথর করে কেঁপে কেঁপে বলে, আমার বোনের এত বড় ক্ষতি তুই করতে পারলি? চয়ন তাকে পুলিশের হাতে তুলে না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তপনকে বলে, বয়সে বড় হয়েও তোমার পায়ে ধরে বলছি, জীবনে আমি বড় ভুল করে ফেলেছি, এমন অন্যায় আমিই করেছি। কাল রাতের ঘটনায় বিবেকের কাছে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। আসলে অনেক আগে থেকেই আমি তিন্নিকে ভালোবাসতাম কিন্তু বলার সাহস পাইনি। তুমি আমাকে পুলিশে দিয়ো না, ভাই। আমি তোমার বোনকে বিয়ে করতে চাই। জীবনে এত বড় অপরাধ মাপের যোগ্য নয়, তবু যদি একবার সুযোগ পাই তাকে বিয়ে করে তার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে চাই। আমি কথা দিচ্ছি তোমার বোনকে নিয়ে সারা জীবন কাটাব, কোনো অবহেলা করব না। তপন বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে। সমাজের ভয়ে চয়নকে পুলিশে না দিয়ে চিন্তা করল, তার কাছেই বোনকে বিয়ে দেবে।
এদিকে তপনের বাবাও দেশে নেই। আজ প্রায় পাঁচ দিন ধরে তিন্নি হাসপাতালে। তার সমস্যা দিন দিন বাড়ছেই। কোনো উন্নতি হয়নি। ভয়ে বারবার চিৎকার করছে। সেই রাতের আতঙ্ক কোনোভাবেই কাটছে না। বারবার চোখ বড় বড় করে বলছে, ওই যে আসছে। ডাক্তার জানালেন, অতিরিক্ত ভয়ে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গেছে তিন্নি। পাঁচ দিন হাসপাতালে রেখে তিন্নিকে বাসায় নিয়ে এসেছে তপন। কাজি ডেকে বিয়ে দেবে, সে পরিস্থিতিও নেই। ঘটনা জেনেও তিন্নির মা আসতে পারছেন না লিগ্যাল কাগজপত্র না থাকায়। তিন্নির বাবা জানার পর দেশে ছুটে এসেছেন। মেয়ের ভয়ংকর অবস্থা দেখে বাবা নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। এ ঘটনার পর চয়ন তিন্নির সামনে এলেই তিন্নি দুই চোখ বড় বড় করে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। বলে, ওই যে আমাকে আবার মারবে চয়ন। অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে চয়ন তিন্নিকে উপযুক্ত সম্মান দিতে চায় কিন্তু এই অবস্থায় কীভাবে সম্ভব? তিন্নির ভাই ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, চয়ন যেন আর তিন্নির সামনে না আসে। তিন্নির সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় সবাই। তাই বিয়ের কাজটাও সারা হলো না। এরই মধ্যে চয়নের আমেরিকা যাওয়ার সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।
আজ প্রায় পাঁচ মাস। তিন্নির শরীরে পরিবর্তন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মা হতে চলেছে তিন্নি! চয়ন এত দিনে বিদেশে চলে গেছে। তিন্নির এই অবস্থায় সমাজের কাছে পরিবারের সবার মুখ দেখানো দায়। পরিবারের সবাই অসহায়। সমাজের কাছে লজ্জিত, অপদস্থ। যথারীতি ফুটফুটে এক বাচ্চা জন্ম দিল তিন্নি। মাতৃত্বের স্বভাবজাত অনুভূতিতে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল তিন্নি। বাচ্চাকে পেয়ে তিন্নি যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। চাঁদের মতো ফুটফুটে বাচ্চা। নাম রাখা হলো জয়। সিজোফ্রেনিয়া থেকে মুক্ত হতে লাগল সে। ডাক্তারের পরামর্শ, বাচ্চাকে যেন তিন্নির কাছ থেকে দূরে না রাখা হয়। তিন্নি এখন রাতদিন কেবল বাচ্চাকে নিয়েই ব্যস্ত। এভাবে কেটে গেল জীবনের ছয়টি বছর। ভাইটি চলে গেল অস্ট্রেলিয়ায়। তিন্নির মা দেশে চলে এলেন মেয়ের কাছে।
এভাবে কেটে গেল ২২টি বছর। সুদর্শন এক যুবকে পরিণত হলো তিন্নির ছেলে জয়। লেখাপড়ায় ভীষণ মেধাবী। ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তিন্নির ছেলে আজ ডাক্তার। ওর জীবন আনন্দে ভরপুর। মায়ের পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও তিন্নির অনুশোচনা ছিল, কে এর বাবা? পরিবার থেকে তিন্নিকে আর কিছু জানানো হয়নি। জয় প্রতিদিন কাজ শেষে মাকে বিভিন্ন রোগীর গল্প বলে। তিন্নিও খুব মনোযোগ দিয়ে ছেলের কথা শোনে। প্রতিদিনের মতো আজও জয় এসে বলে, মা আমি এমন একজন রোগী পেয়েছি, যিনি দেখতে সুদর্শন, ভরাট কণ্ঠ তার। আমেরিকা থেকে এসেছেন, লিউকেমিয়া হয়েছে তার। তিনি যখন কথা বলেন, তাকে ভক্তি করতে খুব ইচ্ছা হয়। রক্তের দরকার ছিল তার। গ্রুপ মিলে যাওয়ায় তাকে আমি রক্ত দিয়েছি। খুব মায়া লাগে ওনার জন্য। দেখে মনে হয়, বুকের মধ্যে ভীষণ কষ্ট নিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছেন। আমাকে দেখলে অস্থির হয়ে যান। বাবা বাবা বলে কথা বলতে চান। শুধু বলেন, আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়ে গেছি, বাবা। রক্ত দেওয়ায় মনে হয় ভদ্রলোক আমার ওপর কৃতজ্ঞ। তাই এত ভালোবাসেন। ওনার রুমে গেলে মনের মধ্যে কেমন যেন অনুভূতি অনুভব করি। মা, তুমি ওনাকে দেখলে বুঝবে কী যে ভক্তি লাগে। মা তোমাকে দেখাতে নিয়ে যাব একদিন। জয় প্রায়ই রোগী দেখাতে মাকে সাথে করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তিন্নি তাদের দেখে সমবেদনা জানালে তারা খুশি হয়। তিন্নি বলে, বাবা আমি যাব ওনাকে দেখতে।
তিন্নি রুমে ঢুকতেই ভদ্রলোক হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। বাবা, তুমি কি ওনার ছেলে? তিন্নি তো দেখে অবাক, এই তো আমাদের সেই চয়ন ভাই! ২২ বছর আগে আমাদের বাসায় এসেছিল, সে স্মৃতি মনে পড়ছে। তিন্নি পাশে গিয়ে করুণ স্বরে বলতে লাগল, আপনি কাঁদবেন না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমার ছেলে এখানকার ডাক্তার, আপনার ভালো চিকিৎসা হবে।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিন্নির সাথে দেখা হওয়ায় চয়নের অনুশোচনা আরো বেড়ে গেল। ডা. জয় কি তোমার ছেলে? তিন্নি মাথা নিচু করে বলল, জি। ও ভীষণ ভালো ছেলে। এরই মধ্যে জয়ের অন্য রুমে যাওয়ার ডাক এল। তিন্নির ছেলে অন্য রুমে চলে যাওয়ার পর চয়ন বলতে শুরু করল, তুমি কি বিয়ে করেছ। তিন্নি বলল, না। কিন্তু কেন বলুন তো? আমি জানতাম, তুমি কোনো দিন আর বিয়ে করবে না। তবে শুনো, আজ থেকে ২২ বছর আগে এক রাতে আমি তোমার সাথে চরম অন্যায় করেছিলাম। তিন্নি চমকে উঠল। ২২ বছর আগের গল্প! কী ঘটেছিল সেদিন? অধীর আগ্রহে জানতে চাইল তিন্নি। চয়ন তিন্নির হাত চেপে ধরে বলল, অবশ্যই বলব। আজ বলার সময় এসেছে। সেই রাতে হঠাৎ কী হয়েছিল, তোমার মনে পড়ে কিছু? সেই রাতে আমিই তোমার সর্বনাশ করেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না? বিশ্বাস করো, এরপর আমি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না। তাই আর বিয়ে করা হয়নি। আমার আমেরিকা যাওয়ার সবকিছু হয়ে যায়। আমি চলে যাই। আমেরিকার চাকচিক্য আর চোখের আড়ালে একসময় তোমার স্মৃতি মুছে যায়। ভালোই কাটছিল কয়েক বছর। বড় একটা কোম্পানিতে আমার চাকরি হলো। আমার অনেক টাকা হলো। বিলাসবহুল বাড়ি হলো। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, শরীর দুর্বল হতে চলেছে। আমি ক্লান্তি অনুভব করলাম। ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম, আমার লিউকেমিয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে শরীর আরো খারাপ হতে লাগল। এখন আমার অনেক টাকা-পয়সা কিন্তু কোনো সুখ নেই। আমার আর বিয়ে করা হয়নি। আমি জানি, আমার সময় খুব কম। আমি সেই সম্মান তোমাকে দিয়ে জীবন থেকে বিদায় নিতে চাই। যে সম্মান তোমাকে সেদিন দিতে চেয়েও দিতে পারিনি, তুমি কি সেই সুযোগ আজ দেবে আমায়? তাহলে আর কোনো কষ্ট থাকবে না মরে গিয়েও।
সেই ভয়াল রাতের অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে চয়ন বারবার ক্ষমা চাইতে থাকে তিন্নির কাছে। সোশ্যাল ওয়ার্কার এবং অন্য সবার সামনে বলতে লাগল, সে আমার বিবাহিত স্ত্রী। আমি ধর্মকে সাক্ষী রেখে তাকে আমার বউয়ের মর্যাদা দিলাম। তিন্নির কান্নার শব্দ শুনে জয় রুমে ঢুকল। জয় অবাক হয়ে দেখছিল, তার মায়ের হাত সেই ভদ্রলোকের হাতের মুঠোয়। চয়ন বলতে থাকে, আমি তোমার জন্মদাতা বাবা, তুমি আমার ছেলে, তিন্নি আমার স্ত্রী। জয় আগেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। তার প্রতি কেন এত টান আমার। আমাকে একটা সাদা কাগজ আর কলম দেবে? দৌড়ে সাদা কাগজ আর কলম এনে দিল জয়। আমার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি ও টাকা আজ থেকে তোমার মা তিন্নির নামে লিখে দিলাম। আমাকে মাফ করো।
হাসপাতালের সোশ্যাল ওয়ার্কারদের সামনে তিন্নির নামে সব লিখে দিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চিরবিদায় নিল চয়ন। ছেলে বাবার শরীরের পার্লস পরীক্ষা করে সাদা চাদর মুখের ওপর টেনে দিল। সে আর নেই জানিয়ে মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, মা, তুমি সত্যিই বিজয়ী আজ। বাবাকে খুঁজে পেয়েছি, তোমাকে বাবা আজ সম্পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন। আমার অনেক ভালো লাগছে। তিন্নির এত দিনের জমে থাকা চোখের জল বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে। বাবার লাশ কফিনে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হিমাগারে। ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। তিন্নি ধীরে ধীরে হাসপাতালের গেটে এগিয়ে গিয়ে যেন ভাবতে লাগল এক রাতের ছায়ার গল্প।
Ñনিউইয়র্ক।