ড. সিনহা এম এ সাঈদ :
রাস্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা থেকে সতের বছর পর পুনরায় সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য ৬ আগস্ট ১৯৯১ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (৩০৭-০ ভোটে গৃহীত) মূলত সংসদীয় কাঠামোর সরকার নয় বরং প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারের জন্ম দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার এই করুন চিত্র নিয়েই আমি “For A President Who Can Take An Initiative : Bangladesh perspective” শিরোনামে একটি বই লেখেছি ২০০৮ সালে যা মূলত বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক “Daily Star” এ প্রকাশিত আমার এ সম্পর্কিত লেখাগুলোর একত্রীকরণ। প্রকাশনায় রয়েছে “Bangladesh Political Science Association”।
সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পদকে অতি আলোকিত করতে যেয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে এমনভাবে সংকোচিত ও সীমিত করা হয়েছে যা দেখে ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান অস্থীয় রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ তার মূল্যায়নে বলেন :
এখন রাষ্ট্র্রপতির কবর জিয়ারত, মিলাদ মাহফিলে যোগদান এবং মুনাজাত করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
তত্ত্বগতভাবে ও বাস্তবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কর্মের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি। প্রতিটা কাজই প্রধানমন্ত্রীর লিখিত স্বাক্ষরে সম্পাদিত হতে হবে। এখানে ‘মৌখিক’ বিষয়টিকে চূড়ান্তভাবে নিরুৎসাহিত বা অসাংবিধানিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বভাবতই, রাষ্ট্রপতির নিজ বিবেক ও স্বেচ্ছাধীন বলে আর কিছু থাকে না। অবস্থানাগত প্রকাশটা যেন হরাইজন্টাল ও ভারটিক্যাল।
বিষয়টি আরো স্পষ্টতর করে বলা যায় যে সংবিধানের মূলত অনুচ্ছেদে ৪৮ এবং ৪৯ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভিত্তি। আবার অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) দফা প্রয়োগেও অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে বাস্তবে তাঁর চোখ বুঝে পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া করার কিছুই নাই। কারন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ সংসদের সংখ্যাগরিষ্ট দলের (জোট বা একক দল) নেতাকেই দিতে হবে অনুচ্ছেদ ৫৬(৩) দফা অনুযায়ী। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে অনুচ্ছেদ ৯৫ (১) দফা মোতাবেক তিনি একক বলে মনে হলেও বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশই চূড়ান্ত যা ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তন থেকে প্রমাণিত হয়ে চলছে।
অনুচ্ছেদ ৪৯ প্রয়োগও অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি নিয়োগও বাস্তবে নির্মমভাবে অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) দফা দ্বারা প্রধানমন্ত্রী-নির্ভরশীল।
রাষ্ট্রপতি পদের ব্যক্তিত্বকে কিভাবে পাওয়া যাবে এ বিষয়ে দুইটি। পদক্ষেপ রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(১) দফায় বলা হয়েছে ‘পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কর্তৃক রাষ্ট্রপ্রতি নির্বাচিত হবেন’। এখানে সুস্পষ্ট যে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী প্রথম ধাপে দল/জোট কর্তৃক মনোনীত হবেন এবং পরের ধাপে সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। প্রথমটিকে বলা হয় দলীয়/ জোট মনোনয়ন এবং দ্বিতীয়টি হলো আইনের বিধান মোতাবেক নির্বাচনে জয়ী হওয়া। পুরো বিষয়টিই রাজনৈতিক এবং সূচনা থেকেই আনুগত্যের প্রশ্নটাই মূখ্য। প্রকারান্তে, দলীয়/জোট প্রধানই সংসদ নেতা ও সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী সে কারণেই একক আনুগত্য তাঁকে ঘিরেই রচিত হয়।
বিষয়টি নতুনভাবে আবারো আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনাব শাহাবুদ্দিনের নির্বাচিত হওয়ার পর বিরোধী বলয়ের নেতিবাচক সমালোচনার উত্তরে বলেছেন :
নতুন রাষ্ট্রপতি ‘ইয়েসউদ্দিন’ হবেন না। অর্থাৎ অন্ধ অনুগত হবেন না (যেমন সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম ইয়াজউদ্দিন আহমেদ যাকে সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অন্ধ অনুগত বলে মনে করা হতো)।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, রাষ্ট্রপতি যিনিই হবেন তাকেই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত হতে হবে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই।
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার অর্থ হলো সংসদের যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তাকে মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচিত করেছ তার/তাদের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা যা আনুগত্যের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। বিভিন্ন জাতীয় সংকট ও প্রয়োজনে এটা জরুরি হয়ে পড়ে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হলো সংবিধানের লিখিত রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষমতা ও কার্যাবলী সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ, ধারা ও উপধারাগুলো।
এই দুটিকেই আমি মনে করি ‘দুই তলোয়ার/উভয় সংকট মতবাদ’। সোজা কথায়, বর্তমান কাঠামোতে একজন রাষ্ট্রপতির মাথার উপর দুইটি তলোয়ার ঝুলন্ত অবস্থায় বিদ্যমান। নিসন্দেহে বলা যায়, রাষ্ট্রপতির পদটি শুধুই সাংবিধানিক পদ নয়, বরং রাজনৈতিক- সাংবিধানিক পদ (Politico- Constitutional Office)। তাহলে রাষ্ট্রপতির সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, সংসদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর বলয়ের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কোথায়?
অতএব, রাষ্ট্রপতির মৌলিক পরিচয় হলো ‘প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর’ (‘Prime Minieter’s Voice’।
লেখক : কলামিস্ট।