এম আর ফারজানা :
সন্ধ্যা হয়ে এল প্রায়। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা বিদায়ের হাতছানি দিচ্ছে। রিনি হাঁটছে রাস্তার ফুটপাত ধরে। গন্তব্য তিথিদের বাসা। টিউশনি শেষ করে ভাবছিল বাসায় চলে যাবে, কিন্তু হঠাৎ মনে হলো তিথির সঙ্গে দেখা করে আসি। রিনির বাবা যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন, তখন মানসিক ও আর্থিকভাবে তিথিই সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিল রিনিকে। সত্যিই এমন বান্ধবী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বলা যায়, রিনির প্রিয় মানুষের নামের তালিকায় তিথির নাম সবার ওপরে। ফোনে প্রতিদিন কথা হলেও ওর সঙ্গে দেখা হয় না অনেক দিন।
আজ ওকে সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। তা ছাড়া আজ রিনির মনও ভালো, টিউশনি থেকে এ মাসের টাকাটা পেয়েছে। এবার তিথির থেকে ধার করা কিছু টাকাও শোধ করা যাবে।
এরই মধ্যে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো। হেঁটে হেঁটে তিথিদের বাসায় পৌঁছাতেই খানিকটা ভিজে গেছে। গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে জামার পিঠের দিকটা।
কলিংবেল বেজেই চলছে, অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে দিল তিথির ভাই রুপম।
তিথি বাসায় আছে? জিজ্ঞেস করল রিনি।
জি আছে, আসুন, ভেতরে আসুন।
রিনি বাসার ভেতরে গেল। এমন নয় যে এ বাসায় আগে কখনো আসেনি। আরও একবার এসেছিল। তবে রুপমকে এই প্রথম সরাসরি দেখল। আগে ছবি দেখেছে ওদের ড্রয়িংরুমে।
বাসায় আধুনিকতার ছাপ, বোঝাই যায় বড়লোকের বাসা। কিন্তু তিথির আচরণে সেটা বোঝা যায় না। না হয় রিনির মতো এমন সাধারণ একটি মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হওয়ার কথা নয়। রিনি এখন শুধু টিউশনি করে সংসার চালায়। বাবার অসুস্থতার পর চাকরিও চলে যায়। ফলে অর্থের অভাবে লেখাপড়াও বন্ধ। জীবনের বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিটা মুহূর্ত রিনিকে লড়াই করে চলতে হচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরেই ড্রয়িংরুমে বসে আছে রিনি। এখন কিছুটা অস্থিরতা লাগছে। তাকে বসিয়ে রুপম কোথায় গেল। রিনি আস্তে করে ডাকল, তিথি। ভেতর থেকে রুপম এসে বলল, তিথি গোসল করছে। আপনি বসুন আরও কিছুক্ষণ।
রুপম এক কাপ চা নিয়ে এল রিনির জন্য। বলল, আমি বানিয়েছি, খেয়ে দেখেন তো কেমন হয়েছে?
কেন? বাসায় আর কেউ নেই? কাজের লোক কোথায়? প্রশ্ন রিনির।
ছিল, এখন নেই। আব্বা-আম্মা কানাডায় বড় আপার বাসায় গেছে, সেটা তো মনে হয় জানেন। যাওয়ার সময় এদের ছুটি দিয়ে গেছে।
ও আচ্ছা। রিনি তখনো বুঝতে পারেনি সামনে কী ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে ওর জন্য। শুধু ভাবছে কত বড়লোক কিন্তু কোনো অহংকার নেই। কী সুন্দর চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। তিথির মতোই ওর ভাই।
চা শেষ করে উঠতে যাবে রিনি কিন্তু পারছে না। কেমন যেন ঢলছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
রুপম এবার বাঁকা করে হাসছে!
আপনি কী মিশিয়েছেন চায়ের সঙ্গে? বলেই পড়ে যাচ্ছিল রিনি।
রুপম এবার রিনিকে জাপটে ধরে। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে রিনি। কিন্তু ততক্ষণে সে নিজেই ঢলে পড়ে। রুপম রিনিকে টানতে টানতে নিয়ে যায় তার রুমে।
আসলে রুপম ছাড়া বাসায় কেউ ছিল না। তার লোভ-লালসার জিহ্বা লকলক করে ওঠে রিনিকে দেখে। তাই সে চেপে যায়, সে যে একা বাসায়। রিনিকে সে আগে থেকে চিনত এবং মনের মধ্যে তখন থেকেই নেশাগ্রস্ত এই পৈশাচিক কামনা বাস করছিল। আজ সুযোগ পেয়ে সে হাতছাড়া করতে চায়নি। রুপম অনেকটা ঠান্ডা মাথার মানুষ। তার নজর একবার যার দিকে পড়েছে, সে রেহাই পায়নি তার লালসার হাত থেকে।
রিনির চোখ আধো বোজা। শরীরের ওপর দিয়ে যেন পৈশাচিক ঝড় বয়ে গেল। লজ্জায়-অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই কদাকার ও বীভৎস ঘটনা তার জীবনে ঘটবে, সে কখনোই ভাবতে পারেনি। আসলে মানুষ জানে না পরমুহূর্তে কী ঘটবে তার জীবনে। তবু অনিশ্চিত ভাবনায় পথ চলে এই ভেবে, সামনে যা কিছু তা হবে সুন্দর। রিনি পুরোপুরি চোখ খোলে, নিজের প্রতি কেমন যেন ঘেন্না লাগছে। তাকিয়ে দেখে, রুপম চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার চোখে তৃপ্তির ঢেউ।
এবার রুপম চেয়ার থেকে উঠে রিনির খুব কাছে এসে বসে, মোবাইলে দেখায় রিনির বীভৎস ভিডিও এবং বলে, এখন থেকে যখন ডাকব, তখনই আসবে। আর রিনির হাতে ধরিয়ে দেয় এক বান্ডিল টাকা, সেই সঙ্গে বলে, এখন থেকে টাকার অভাব হবে না। অত কষ্ট করে টিউশনি করার কী দরকার। আমি তোমাকে হেল্প করব, শুধু আমার কথামতো কাজ করলেই হবে।
রিনি রোবটের মতো তার কথাগুলো শুনে যায়। এ মুহূর্তে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছে না।
রিনি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়, শরীর ঝিমঝিম করছে, তবু চেষ্টা করছে। নিস্তেজ শরীরটাকে টেনে নিয়ে বের হয় রুম থেকে। আস্তে আস্তে রাস্তায় নামে। ততক্ষণে রাতের নিয়ন বাতিগুলো জ্বলছে রাস্তার চারপাশে। সবার ঘরে ফেরার তাড়া। যানবাহনগুলো ছুটে চলেছে।
কে কার আগে যাবে, যেন এই প্রতিযোগিতা। রিনি নিজেকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা আমি কি থানায় যাব? পরক্ষণেই ভাবে, না। সমাজের উঁচুতলার মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব না। আচ্ছা, তিথিকে কি বলব? না, একজন ভাই যত খারাপই হোক, বোনেরা তা বিশ্বাস করতে চায় না।
আজকের এই বীভৎস ঘটনার জন্য তো রিনি দায়ী নয়। না, কিছুই ভাবতে পারছে না। বাসায় যাই। রিকশা ডাকে। সকালের রিনি আর এই বিকেলের রিনির মধ্যে কত পার্থক্য, ভাবে সে। বাসায় পৌঁছে নিজের রুমে ঢুকে যায়।
কী হয়েছে তোর? এমন দেখাচ্ছে কেন? প্রশ্ন করেন রিনির মা।
কিছু হয়নি, মাথা ধরেছে। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। রিনি চেপে যায় সবকিছু।
শোনো মা, আমি রাতে কিছু খাব না। আমাকে ডেকো না। আর এই নাও টিউশনির টাকা, বলে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।
আলোটাও ভালো লাগছে না। লাইট বন্ধ করে ফ্লোরে বসে থাকে রিনি। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল, সে নিজেই জানে না।
না, এ বীভৎস ঘটনা কাউকেই বলা যাবে না। বললে বরং তার দিকেই সবাই আঙুল তুলবে। তার বাবা-মাকে সমাজ তুচ্ছ-তাচ্ছিল করে বলবে, ওই যে ধর্ষিতার বাবা-মা। তার ভাইকে অপমান হতে হবে পদে পদে। আর আইন? সেখানে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বর্ণনা করতে হবে কেন হলো, কী হলো, কীভাবে হলো; যেন আরও একবার ধর্ষিত হওয়া। দেখা যাবে রুপম পার পেয়ে যাবে টাকার জোরে, উল্টো রিনির জীবন যন্ত্রণার আগুনে বিদ্ধ হবে সমাজের মানুষের তীক্ষ্ন কথার বানে।
এবার রিনির মাথায় অন্য বুদ্ধি কাজ করে। না, রুপমকে কিছুই সে বুঝতে দেবে না। যা বলে তা-ই শুনবে। এরপর রিনি যা করার নিজেই করবে।
এভাবেই কেটে যায় কয়েক মাস। এর মধ্যে কয়েকবার রিনি রুপমের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তবে রিনি তাকে ফোন করে বাইরে থেকে, নিজের মোবাইল থেকে নয়। যেদিন দেখা করবে, সেদিন কোনো কথাই বলে না ফোনে। উল্টো সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রিনি নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বলা যায়, সে তার প্ল্যানমতো এগোচ্ছে।
না, তিথি কিছুই জানে না। একদিন রিনি বলে, রুপম, আমি তো আপনার সব কথাই শুনছি আমার একটা কথা কি রাখবেন?
অবশ্যই রাখব। বলেই দেখো। কী টাকা লাগবে? তোমাকে তো বলেছি টিউশনি ছেড়ে দাও, যা লাগবে আমি দেব।
না, টাকা নয়। আমার আসলে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। আপনি কি আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারবেন? হ্যাঁ পারব। কোথায় যেতে চাও।
আমার নৌকা ভ্রমণ খুব পছন্দ। খুব ইচ্ছা করছে। যদি নিয়ে যেতেন, কৃতজ্ঞ থাকতাম।
রুপম বলে, কিন্তু আমি ভয় পাই, সাঁতার জানি না।
ভয়ের কী আছে, আমি তো সঙ্গেই থাকব।
যেই ভাবা সেই কাজ। দুজনে একদিন বিকেলে ঘুরতে যায় নৌকা ভ্রমণে। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকায় দুলছে। রিনি নৌকায় বসে পা দোলাচ্ছে আর রুপমকে ডাকছে তার হাত ধরে গান শোনাতে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। অবাক ব্যাপার, এর মধ্যে শুরু হয় ঝুমবৃষ্টি।
যেই রুপম কাছে আসে, সুযোগ বুঝে রিনি তাকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেয়।
রুপম চিৎকার করে। কিন্তু তার সে চিৎকার খুব শোনা যায় না ঝুমবৃষ্টির কারণে। রিনি ফিরে আসে বাসায়, রুপম যে সাঁতার জানে না, রিনি আগে থেকেই জানত, এমনকি তিথিও সাঁতার জানে না। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিথিই বলেছিল, জানিস, ভাইয়া ও আমি কেউই সাঁতার জানি না।
এক অপরাধবোধ কাজ করছে রিনির মধ্যে। তবে এই ভেবে ভালো লাগছে, এটাই তার প্রাপ্য ছিল। সে সমাজের নর্দমা।
পরদিন পত্রিকার পাতায় নিউজ আসে, সাঁতার না জানায় ডুবে মারা গেলেন এক যুবক।
তিথির সঙ্গে কথা হয় রিনির। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিথি। সান্ত্বনার বাণী শোনায় রিনি।
জানিস, ভাইয়া সেখানে আমাদের না বলে কেন গেল, সেটাই বুঝতে পারছি না। আর সে তো সাঁতার জানে না। নৌকায় উঠতে বরং ভয় পেত। রিনি বলে, হয়তো শখ হয়েছে। মানুষের মনে কখন কী আসে সে কি আর জানে আগে থেকে।
রুপমের বাবা-মা ছেলের এই খবর শুনে কানাডা থেকে ফিরে আসেন। তারা খোঁজ নিতে থাকেন, সে কি সত্যি মারা গেছে নাকি কেউ খুন করেছে। তাদের কত ব্যবসায়িক শত্রু তো আছে। পুলিশে রিপোর্ট করেন, কেস ফাইল করেন অজ্ঞাতনামা কিছু মানুষকে সন্দেহ করে। সেদিন তার সঙ্গে কারা ছিল। পুলিশ এসব তদন্ত করতে গিয়ে দেখে রুপম অপরাধজগতের সঙ্গেও জড়িত ছিল। তার কয়েকজন গার্লফ্রেন্ড। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে তারা এসবের সঙ্গে জড়িত নয়। কোনো ক্লু পাচ্ছে না। তা ছাড়া তার মোবাইল ফোনের রেকর্ডও চেক করা হয়েছে। যাদের সঙ্গে কানেক্টেড ছিল, তারা কেউ জড়িত নয়।
রুপমের বাবা-মা বরং অবাক হয়েছেন। ছেলের এত অধঃপতন। তারা এখন ছেলের তদন্তের চেয়ে নিজেদের মানসম্মান নিয়ে ভাবছেন।
তিথি তার বাবাকে বলে, দরকার নেই এত কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করে, কী হবে ভাই তো আর ফিরে আসবে না। বাদ দাও আইনি ঝামেলা। তিথির বাবা-মা একটু অবাক হন। তিথি বলে, তোমার ছেলের যে কর্মকাণ্ড বের হচ্ছে, তাতে যেটুকু সম্মান আছে, সমাজে তা যাবে। অপরাধজগতে এত বিচরণ, তাতে বরং আমরাই আরও ঝামেলায় পড়ব।
এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। রুপমের মৃত্যুবার্ষিকী চলে আসে। তিথির বাবা-মা রুপমের জন্য দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করেন। রিনিকেও আসতে বলে তিথি। তাদের বন্ধুত্ব আগের মতোই আছে।
মিলাদ শেষে বিদায় নিচ্ছিল রিনি, তিথি পেছন থেকে ডাক দেয়-রিনি, শোন, সাবধানে যাস। আমরা যা ভাবি তা অনেক সময় ঘটে না, আবার যা কখনো চিন্তাই করি না, তা ঘটে যায়। জীবনের মোড় আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় সময়ের কাঠগড়ায়।
রিনি কিছু বলে না, সামনে পা বাড়ায় আর ভাবে, তিথি কি জেনে গেছে? উত্তর খুঁজে পায় না।
-নিউজার্সি থেকে, ১১ মার্চ ২০২৩