রোজায় খাবার গ্রহণ ও বর্জন

রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস হলেও এ মাসেই খাবারের মহোৎসব শুরু হয়। এ সময় ভোজনে অসতর্কতা আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। রমজান মাসে ইফতার থেকে সাহরির শেষ সময় পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করুন। অন্যথায় দিনের বেলায় পানিশূন্যতার সৃষ্টি হয়ে সমস্যা হতে পারে। সাহরিতে বেশি মশলা ও লবণযুক্ত খাবার খাবেন না। এসব খাবার রোজা রাখা অবস্থায় পিপাসা বাড়িয়ে দেয়। এর পরিবর্তে সবজি ও ফল খাওয়া যেতে পারে। এতে থাকা জলীয় অংশ পাকস্থলীতে বেশিক্ষণ থাকে। সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারি করার সময় আমরা বিভিন্ন পানীয় গ্রহণ করে থাকি। হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা ফুটপাথে যেসব পানীয় শরবত হিসেবে পরিবেশন করা হয় তার অধিকাংশ পানীয়তে বরফ মেশানো থাকে। এসব বরফ আসে মাছ হিমায়িত করার জন্য। শোনা যায়, মানুষ মারা যাওয়ার পর যে বরফ ব্যবহার করা হয় মূলত এসব উৎস থেকে বরফ বিভিন্ন শরবতের দোকান, রেস্টুরেন্ট এবং হোটেলে সরবরাহ করা হয়। সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারির সময় ভুলেও এ জাতীয় শরবত দিয়ে ইফতারি করবেন না। এ ছাড়া ফালুদাতেও এ ধরনের বরফ ব্যবহার করা হয়। এসব পানীয় বা খাবার গ্রহণ করলে পেটের পীড়াসহ যেকোনো ধরনের অসুখ হতে পারে। ইফতারে পান করতে পারেন বিশুদ্ধ পানি, ডাবের পানি ও ফরমালিনমুক্ত ফলের রস। সবচেয়ে ভালো হয় শুধু এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ইফতারি শুরু করা। আমাদের দেশে ইফতারির একটি অপরিহার্য অংশ মুড়ি। মুড়ির আকার বড় এবং রঙ সাদা করার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। ইউরিয়া মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। ইউরিয়া হজমের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরিয়েজ এনজাইম মানবদেহে না থাকায় মানুষ ইউরিয়া হজম করতে পারে না এবং ইউরিয়া দেহেই থেকে যায়। ইউরিয়া খেলে এসিডিটির সমস্যা থেকে মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই মুড়ি খেতে হবে রয়ে-সয়ে এবং দেখে-শুনে। সাদা মুড়ি বর্জন করে হাতে ভাজা মুড়ি খাওয়া উচিত। হাতে ভাজা মুড়ি ইউরিয়ামুক্ত, মুড়ির রঙ সামান্য হলদেটে হয়ে থাকে। অপরিমিত কফি বা চা পান থেকে বিরত থাকুন। সাহরির সময় চা এবং কফি সম্পূর্ণ বর্জন করবেন। কারণ কফি বা চায়ে বিদ্যমান ক্যাফেইনের ডাইয়্যুরেটিক কার্যকারিতার জন্য শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়।
অনেকেই সাহরি ও ইফতারে কার্বোনেটেড ও চিনিযুক্ত কোমল পানীয় পান করেন। এসব কার্বোনেটেড ও চিনিযুক্ত কোমল পানীয় এবং এনার্জি ড্রিংকস দেহ থেকে বেশি পানি বের করে দিয়ে দেহে পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে। তাই ইফতার ও সাহরিতে শুধু বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। রোজাদাররা অনেকেই সাহরির সময় দুধ-কলা অথবা আম-দুধ দিয়ে ভাত খেয়ে থাকেন। কলা খাওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে কলাতে কার্বাইড মেশানো হয়েছে কিনা? এ জন্য কলা কেনার সময় দেখে-শুনে কিনতে হবে। কার্বাইডে পাকানো কলার বোঁটা হালকা সবুজ থাকে এবং কলার খোসা বা উপরিভাগ দাগহীন পরিষ্কার হলুদ রঙের হয়ে থাকে। স্বাভাবিক কলা কখনোই এ রকম দাগহীন পরিষ্কার হলুদ রঙের হয় না। ইফতারি করার সময় আমাদের আলু চপের চেয়ে ডিম চপের দিকে নজর বেশি থাকে। বাজারে ডিম দিয়ে বিভিন্ন ইফতারসামগ্রী বিক্রি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বিদেশ থেকে পাচারকৃত কৃত্রিম ডিমও দেখতে পাওয়া যায়। রমজান মাসে বেশি লাভের আশায় এসব কৃত্রিম ডিমের বিক্রি বেড়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই ইফতারির সময় বাজার থেকে ক্রয়কৃত ডিম চপ বা ডিমের সামগ্রী না খাওয়াই উত্তম। অধিকাংশ ফলেই ফরমালিন এবং রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। তরমুজের ভেতর ইনজেকশন আকারে কৃত্রিম লাল রঙ প্রবেশ করানো হয়, যাতে তরমুজ কাটার পর টকটকে লাল দেখা যায়। শসা ও ক্ষীরা এ জাতীয় ফলে এখনও ফরমালিন মেশানোর খবর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ছোট চিনি চম্পা কলা এবং বিচি কলা খাওয়া যেতে পারে অনেকটা চিন্তামুক্তভাবে। তাই দামি ফলের পরিবর্তে এসব ফল খেতে পারেন। কিডনি রোগীদের মাঝে যারা রোজা রাখতে পারেন তাদের ক্ষেত্রে প্রোটিন সমৃদ্ধ ভাজাপোড়া ইফতারি একদম ঠিক নয়। সুগন্ধি চাল বা স্বাভাবিক চাল দিয়ে ঝাউভাত খাওয়া ভালো। কিডনি রোগীরা অধিক প্রোটিন জাতীয় খাবার পরিহার করবেন। কোনো অবস্থাতেই ডাল খাবেন না। যাদের কিডনির অবস্থা খুবই খারাপ তাদের ক্ষেত্রে জীবন বিপন্ন করে রোজা রাখার আগে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। রোজাদারদের মধ্যে যারা হোটেলে খাবার গ্রহণ করেন তারা কখনোই হোটেলে মুরগি খাবেন না। মুরগির পরিবর্তে মাছ ও সবজি বা ডিম খেতে পারেন। রমজান মাস সংযম এবং ত্যাগের মাস। অধিক পরিমাণ খাবার গ্রহণ থেকে আমাদের সবার সংযমী হতে হবে। রোজা রাখার পাশাপাশি আমাদের কথাবার্তা ও দৈনন্দিন কাজ-কর্মে প্রকৃত সংযমী হয়ে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে।
ড. মো. ফারুক হোসেন, লেখক : মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ