ঢাকা : শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চায় ভারত। সংকট সমাধানে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশকেই সহযোগিতা করছে তারা। গত ৯ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে এসব কথা জানান সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক। অন্য দিকে ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিজয় কেশব গোখলে বলেন, দুই দেশ (বাংলাদেশ ও ভারত) সন্ত্রাস দমনে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। ভারত দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়। দুই দেশের সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ উচ্চতায়। এ সময় উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনে বাংলাদেশকে শুভেচ্ছা জানান গোখলে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বৈঠক সম্পর্কে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত যত দ্রুত সম্ভব এগুলোর সমাধান করবে। এতে আমরা আমি খুশি।
এর আগে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সড়ক অবকাঠামো এবং যোগাযোগসংক্রান্ত ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এগুলোর মধ্যে
রয়েছেÑ নুমালিগড় এবং পার্বতীপুরের মধ্যে মৈত্রী পাইপলাইন স্থাপন, প্রসার ভারতী এবং বাংলাদেশ বেতারের মধ্যে সহযোগিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিসিআর উর্দু চেয়ার প্রতিষ্ঠা এবং জিসিএনইপি-বিএইসির মধ্যকার চুক্তির বর্ধিতকরণের সমঝোতা। এ ছাড়া দুটি অনুদান প্রকল্পের জন্যও সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। একটি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের ৫০৯টি স্কুলে ভাষা গবেষণাগার স্থাপন করবে ভারত।
অন্য প্রকল্পটি হলো- রংপুর শহরের কয়েকটি সড়ক উন্নয়ন। সমঝোতা স্মরকগুলোর বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, জনকল্যাণ, সড়ক অবকাঠামোসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক খাতের উন্নয়নে আমাদের অংশগ্রহণ প্রচেষ্টার অংশ এটি। এ জন্য আমরা ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দিচ্ছি। ভারতকে বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করে বিজয় গোখলে বলেন, গেল সাত বছরে বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৮০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে, ফলে এ ঋণ খুবই কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ শুধু ভারতের ঘনিষ্ঠই নয়, বরং দুই দেশের পথচলা একসঙ্গেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এ প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গোখলে বলেন, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর এবং ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, তার প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য দ্বিতীয় ধাপে মানবিক সহায়তা পাঠানোরও ঘোষণা দেন। এর আওতায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন সরঞ্জামের সঙ্গে গুঁড়া দুধ, শিশুখাদ্য, শুকনো মাছ, রান্নার চুলা ও জ্বালানি, রেইনকোট এবং গামবুটও থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ভারত এর আগে গেল বছর সেপ্টেম্বরে ৩ লাখ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছিল। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ যেভাবে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। বাস্তুচ্যুত লোকজনকে দ্রুত তাদের দেশে ফেরাতে এবং এ সংকট সমাধানে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনেও ভারত উন্নয়ন কর্মকা- চালাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে যারা ফেরত যাবে, তাদের জন্য রাখাইনে ঘরবাড়ি নির্মাণে কাজ করছে ভারত।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তাদের যে অবস্থান; বিশেষ করে তারা যে এ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়, তাতে আমরা খুবই খুশি। সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় বৈঠক শুরু হয়। এরও আগে কেশব গোখলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দুই দেশ সমানভাবে লাভবান : একই দিনে হোটেল সোনারগাঁওয়ে ইনস্টিটিউট অব পলিসি, এ্যাডভোকেসি এন্ড গভর্ন্যান্সের (আইপিএজি) উদ্যোগে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে এখন স্বর্ণযুগ চলছে। দুই দেশের সম্পর্ক শুধু দুই দেশের সরকার নয়, মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তি বা সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে দুই দেশ সমানভাবে লাভবান। অমীমাংসিত সব বিষয় ধাপে ধাপে সমাধানের আশা করে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে সহযোগিতা করতে দ্বিতীয় ধাপে রিলিফ দিতে যাচ্ছে ভারত। উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনে উত্তরণকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে বাংলাদেশকে ভারত অন্যতম ইঞ্জিন মনে করে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ঐতিহাসিক সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে। দুই দেশের প্রায় সব বিষয় সমাধান হয়ে গেছে। এখন শুধু এগিয়ে চলা। আমাদের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় কিভাবে আরও বিস্তার করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, এটি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে বিজয় কেশব গোখলের বাংলাদেশে প্রথম সফর। এ সফর এমন সময় ঘটছে, যখন কয়েক বছরে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা ঝালাই করার সঙ্গে সঙ্গে আগামীর চলার পথের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। এর আগে ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে গত ৮ এপ্রিল বিকেলে তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। গত ১০ এপ্রিল সকালে তিনি ঢাকা ছাড়ছেন।