রোহিঙ্গা সংকটের ৫ বছর : অতঃপর…

মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয়প্রার্থীদের বাংলাদেশে আগমনের অর্ধ দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেল। ২৫ আগস্ট ২০১৭-তে তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সে দেশের মিলিটারি শাসকদের চরম নিপীড়নের মুখে সবকিছু ফেলে শুধু প্রাণ নিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসেন। সামরিক বাহিনীর লোকেরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। শিশু, নারী, বৃদ্ধা, অসুস্থ, সুস্থ কেউ রেহাই পাননি মিয়ানমারের জুলুমবাজ সরকারের হাত থেকে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে বসবাস করে আসছিলেন এবং তারা প্রায় সবাই ছিলেন ধর্মে মুসলমান।

বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনা করে এই অসহায় ছিন্নমূল রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল কক্সবাজার এলাকায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রাণের ভয়ে এক কোটি মানুষের পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের ইতিহাস স্মরণে রেখেই এই মানবিকতা দেখিয়েছিলেন। বাঙালিদের সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এও ভেবেছিলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে হোক বা মিয়ানমার সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তারা আবার নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে পারবেন।

১৯৭১ সালে বাঙালিরাও দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিলেন নিজ নিজ গৃহে। নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন তাদের ভালোবাসার সংসার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বোধ এবং অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের মাটিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি সংগতভাবেই ভেবেছিলেন, রোহিঙ্গারাও অচিরেই স্বদেশে ফিরে গিয়ে আবার নিজেদের সংসার পাতবেন। কেইবা ভিন দেশে শরণার্থী জীবন কামনা করে? এ জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছ থেকে প্রশংসিত হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা মানবতার মা আখ্যাসহ ভূয়সী প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশ, বড় বড় শক্তি বাংলাদেশকে সাহস এবং আশ্বাসের কথাও শুনিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কতিপয় দেশ এবং কুয়েত, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিল।

২০১৭ সালের ঘটনা। প্রথম কয়েক সপ্তাহেই ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা দেশত্যাগ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এরপর দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের স্রোত এসে ঢোকে বাংলাদেশে। সেই স্রোতে নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, চলনশক্তিহীন পঙ্গু, কেউ বাদ পড়েন না। আসার পথে নদীতে ডুবেও অনেকের সলিলসমাধি হয়। আশ্রয়প্রার্থীদের মুখে তাদের নির্যাতনের বর্ণনা শুনে সভ্য সমাজের বিবেকবান মানুষ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্য সময়েও এমন অমানবিকতা শান্তির ধর্ম বৌদ্ধ সমাজে কী করে সম্ভবÑতা কারও ভাবনায় আসতে পারে না! মিয়ানমারের পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় জীবন নিয়ে যখন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে রোহিঙ্গারা ঘর থেকে বের হন, তখন তারা নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী নাকি রাখাইনে পোড়ামাটি নীতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের গণহত্যায় মেতে উঠেছে।

এখন আর রাখাইন থেকে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসছেন না। আসছেন না, কারণ এখন রাখাইনে মুসলমান আর কোনো রোহিঙ্গা অবশিষ্ট নেই। এখন সেখানে মিয়ানমারের সেনানায়কেরা বসতির সব চিহ্ন মুছে ফেলার কাজে ব্যস্ত রয়েছে। তবে পাঁচ বছরে ইতিমধ্যেই ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। সেই সঙ্গে আরো দেড় লক্ষাধিক নতুন শিশুর জন্ম হয়ে মোট রোহিঙ্গা সংখ্যায় সাড়ে ১২ লাখে পৌঁছেছে। যত দিন যাবে, এই সংখ্যা বেড়ে যেতেই থাকবে। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে সরকার। ভাসানচরে সুন্দর আবাস গড়ে তুলে সেখানে বেশ কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্থানান্তর করা হয়েছে।

যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে, প্রত্যাবাসন প্রশ্নে সংকট তত ঘনীভূত হয়ে উঠছে। প্রত্যাবাসনের কোনো আলামত বা সম্ভাবনা কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। দ্বিপাক্ষিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের চুক্তি থাকার সুবিধাটাই নিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনানায়কেরা। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে। তখন মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অং সান সু চি নিজে আদালতে গিয়ে সামরিক জান্তার গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে সাক্ষ্য দিয়ে আসেন। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ের মতো সেই সামরিক জান্তার হাতেই বন্দী হয়ে সু চি এখন কারান্তরালে।

বেশ কিছুদিন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল না। সম্প্রতি জাতিসংঘের ইউএনআই, কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস মিসেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশে সফরে গেলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন করে আলোচনা শোনা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা কমিশনারের সামনে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে গণহত্যা দিবস পালন করে। নতুন করে আওয়াজ উঠেছে রোহিঙ্গা সংকটের ন্যায়সংগত সমাধানের। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তারা আজ রাষ্ট্রহীন।

মিয়ানমার যেভাবে যতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায়, তা কোনোভাবেই ন্যায়সংগত সমাধান নয়। ন্যায়সংগত সমাধান বলতে সবাই মনে করে, তাদের সব রকম নিরাপত্তা প্রদানসহ নাগরিকত্বের সব অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আর বাংলাদেশের প্রয়োজন এখন বহুপাক্ষিকভাবে এই সংকট সমাধানে জোর দেওয়া। আরো একটি খুব জরুরি কথা এই যে, কূটনৈতিক সমাধান ব্যতীত এ সংকটের সমাধানের আর কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরো দক্ষ, আরো মেধাসম্পন্ন কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি আছে কি না, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তা ভেবে দেখা দরকার।

যা-ই হোক, আমরা রোহিঙ্গা সংকটের একটি দ্রুত ও ন্যায়সংগত সমাধান প্রত্যাশা করি। আজকের এই সভ্য যুগে রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপন করুক, তা কারো কাম্য হতে পারে না। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহে মাদক ব্যবসাসহ নানা অসামাজিক কাজকর্ম ছড়িয়ে পড়ছে। সেই পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আগেই এই সংকটের সমাধান আমরা কামনা করি।