রোহিঙ্গা সংকট : বোঝার ওপর শাকের আঁটি

বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা যে সংকট সৃষ্টি করেছে, তা কি আরো গভীর হয়ে সমাধানের পথ আরো সংকুচিত করে তুলছে? বাংলা প্রবাদের মতো ‘গোদের উপর বিষফোড়া’ হয়ে দেখা দিচ্ছে? ইতিমধ্যেই ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান, মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও নিজ দেশে শান্তিতে নোবেলজয়ী নেত্রীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নিজস্ব নানা সমস্যা-সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
তার অর্থ এই নয় যে, তাদের এই সাময়িক আশ্রয় স্থায়ী রূপ নেবে। একটি গোষ্ঠী নিজ দেশের বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও অন্য একটি দেশে আশ্রিতের মানবেতর জীবনযাপন করবে। এদিকে পুরনো এই সমস্যা তো আছেই, তার সঙ্গে আরো কঠিন নতুন নতুন সমসা যুক্ত হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ভারতে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভারত সরকার জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিকে মিয়ানমার থেকে সম্প্রতি বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নাগরিকদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার এবং তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান দূরে থাক, তা আরও ঘনীভূত ও জটিল হচ্ছে। বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় স্থায়ী হতে চলেছে। বাংলাদেশকে, মনে হচ্ছে, সবাই ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ মনে করছে।
এদিকে বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃকও স্বীকৃত ভারত-চীনের রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে যে ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়, তারা বাংলাদেশের পিঠে বন্ধুত্বের মধু লাগানো হাত বুলিয়ে গলায় বিষ মাখানো ছুরি চালাচ্ছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা অন্যান্য দেশ, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলোর আচরণেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরাখবরে যা মনে হয়, তাতে যাদের কার্যকর ভূমিকায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিলতে পারে, তারা কেবল মৌখিক সেবাই দিয়ে যাচ্ছে। আর রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য-আশ্রয় ও চিকিৎসা বাবদ যে সাহায্য আসছে, সেসব থেকে কেবল সংকট দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেওয়ার আভাসই পাওয়া যায়। স্থায়ী সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ, এমনকি বিশ্বাসযোগ্য কোনো মৌখিক আশ্বাসও নেই।
এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করে করা যাবে না, যে যত মৌখিক সার্ভিস দিক রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কিংবা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের যত প্রশংসা করুক আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে ভূষিত করুক, তাতে ভবি ভুলবে না। এর জন্য চাই স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ, মুখের কথায় চিড়া ভিজবে না। মিয়ানমারের ‘গণতান্ত্রিক নেত্রী’ (?) অং সান সু চিকে দেওয়া আন্তর্জাতিক অনেক খেতাব প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। সেসব খবরে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-কষ্ট, তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং হত্যা-ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, দেশ থেকে বিতাড়নের অমানবিক সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। সু চির প্রতি, মিয়ানমারের জেনারেলদের প্রতিও ধিক্কার-নিন্দা উচ্চারিত হতে শোনা যায় আন্তর্জাতিক মহল থেকে।
সবকিছুই মিয়ানমার সরকার ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে হচ্ছে। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের কথা কোথাও শোনা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের জন্য আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো আলো কেউ দেখাতে পারছে না। বরং নিত্যনতুন সংকটের মুখে বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অন্ধকার আরো ঘনীভূত হয়ে উঠছে। নতুন করে বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীও নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সিল করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জানি না, এতে বাংলাদেশমুখী মিয়ানমারের শরণার্থী স্রোত বন্ধ হবে কি না। যদি সেই স্রোত বন্ধও হয়, তবু সংকটের তো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা ইতিমধ্যে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের কী হবে।
যে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার কথাবার্তা মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাতে তাকে ‘মামাবাড়ির আবদার’ ছাড়া কিছু বলা যায় না। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নতুন করে আতঙ্কিত হয়ে অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরে না যাওয়ার দায়ভারও বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে মিয়ানমার। কথায় যে বলে, দুর্জনের অজুহাতের অভাব হয় না! তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত মিয়ানমার এবং একদা সুজন বলে পরিচিত নব্য দুর্জন অং সান সু চি। সত্যকে পাশ কাটিয়ে মিয়ানমার বারবার দুর্জনের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। গোপনে-প্রকাশ্যে মিয়ানমার তাদের দুষ্কর্মের সমর্থনও পাচ্ছে এমন সব শক্তির কাছ থেকে, যারা বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে পরিচিত।
প্রায় তিন বছর আগে বাংলাদেশে স্রোতের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন শুরু হওয়ার পর থেকে ঠিকানার পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে সু চির প্রতি উচ্চারিত ধিক্কার, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা, কোনো কিছুই রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্দশা মোচনে কাজে লাগবে না। বাংলাদেশও মুক্তি পাবে না এই সংকট থেকে। মানবতা, মনুষ্যত্ব, সভ্যতা ও শান্তির বিবেকও নড়বে না কোনো ললিত বাণীতে। এ জন্য দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। মিয়ানমারকে, বিশেষ করে মিয়ানমারের দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও মিত্র, চীন ও ভারত এই দুটি দেশের ভূমিকাই অত্যন্ত হতাশাজনক। বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ দুটি দেশই আবার বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে পরিচিত। সে কারণে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা সম্ভব হয়ে উঠছে না। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানও মিলছে না।
আসলে স্বার্থ বড় জ্বালার। স্বার্থের কাছে অনেক বিশ্বাস-আদর্শ হার মানে। ভারত-চীনের ভূমিকাও তাদের স্বার্থের রজ্জুতে বাঁধা। তাই মুখে তাদের যতই মানবতা, বিশ্ব সভ্যতা ও শান্তির কথা উচ্চারিত হোকÑএ সংকট সমাধানে কার্যত তাদের কোনো উদ্যোগই নেই। অনেকে মনে করেন, দেখাও যাবে না সে রকম উদ্যোগ কোনো দিন। যুক্তরাষ্ট্রও এই সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে যাচ্ছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
বাংলাদেশের জন্য মৌখিক আশ্বাস আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আর্থিক সাহায্য ছাড়া সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রেরও কার্যকর কোনো প্রয়াস নেই। ভারতকে অসন্তুষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নেবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না। অথচ এই সংকট বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রেও হুমকি তৈরি করছে। নানা অসামাজিক এবং অনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। এবং অনেক সমাজবিজ্ঞানী এ রকম আশঙ্কা করছেন যে এই সংকট আজ বাংলাদেশের মনে হলেও অচিরেই তা আর বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ছড়িয়ে পড়বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে মিয়ানমার শরণার্থীরা স্থানীয়ভাবে সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি যে দুর্বিষহ হুমকি সৃষ্টি করছে, তাতে মাদক ব্যবসা, দেহ ব্যবসা, ছিনতাই, এমনকি খুন-সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে। এবং অচিরেই তা পার্শ্ববর্তী দেশসমূহেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।
আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য, তার অস্তিত্বের জন্য সংকট সৃষ্টির আগেই এ থেকে বের হয়ে আসার পথ বের করতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে মানবিকতার খাতিরে যতটুকু করা সম্ভব, তার চেয়েও অনেক বেশি করা হয়ে গেছে। এর চেয়ে বেশি করতে গেলে তা হবে আত্মঘাতী। এখন অবস্থা হচ্ছে ‘নিজে বাঁচলে বাপ-দাদার নাম’। এখন কে অসন্তুষ্ট হবে, সেই ভাবনার সময় নেই।