কক্সবাজার : গত বছর আগস্টে নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সহানুভূতির সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছিল কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা। এ সময় বাস্তুহারা এসব মানুষের সহযোগিতায় যতটুকু সম্ভব, তা নিয়েই এগিয়ে এসেছিল তারা। তবে সময়ের ব্যবধানে সে সহানুভূতি এখন পরিণত হয়েছে চাপা ক্ষোভে।
স্থানীয়রা বলছেন, রোহিঙ্গারা আসার পর স্থানীয়দের কৃষিজমি কমে এসেছে । কমছে কর্মসংস্থান ও আয়। ধ্বংস হচ্ছে পাহাড় ও বন। বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, ছিনতাই, খুন-খারাবিসহ নানা ধরনের অপরাধ। এসব কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের সহানুভূতি এখন আর নেই।
রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা শুরু হলে প্রাণ বাঁচাতে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড় ও রাস্তায় অবস্থান নেয় তারা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস করে। বিপরীতে সেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪ লাখ ৭৭ হাজার। রোহিঙ্গাদের তুলনায় স্থানীয়রা এখন সংখ্যালঘু। আবার এ ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসতঘর করতে গিয়ে বিলীন হয়ে গেছে পাহাড়, কাটা পড়েছে অসংখ্য গাছ।
উখিয়ার ক্যাম্পের পাশের গ্রামের বাসিন্দা দিদারুল ইসলাম। বনের কাঠ সংগ্রহ ও দিনমজুরির মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করেন তিনি। স্থানীয় এ বাসিন্দা জানান, রোহিঙ্গারা ক্যাম্প এলাকার বনের কাঠ শেষ করে এখন পাশের এলাকার বনের গাছ কেটে কাঠ সংগ্রহে নেমেছে। কাঠ সংগ্রহ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয়দের সঙ্গে গ্রামবাসীর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হচ্ছে। প্রশাসনকে এ বিষয়ে জানানো হলেও কোনো সমাধান আসছে না।
১৯৪৭ সাল থেকে উখিয়ার মধুরছড়ায় সরকারি পাঁচ একর জমিতে বন জায়গিরদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে মো. লিয়াকত আলীর পরিবার। দাদা ও বাবার পর এ দায়িত্ব এখন ৫৬ বছর বয়সী লিয়াকত আলীর। সরকারি জমিতে পানের বরজ ও লাউ চাষ করে সংসার চালাতেন তিনি। গত বছর পান ও লাউ বিক্রি করে আয় হয়েছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু মাত্র আট মাসের ব্যবধানে সেসব এখন পুরনো স্মৃতি। তার চাষাবাদের সরকারি জমিতে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। বিলীন হয়ে গেছে ইজারা নেয়া সামাজিক বনায়নের ২৪ হাজার গাছও। সব হারিয়ে লিয়াকত আলী এখন ক্ষুব্ধ। তাই রোহিঙ্গাদের কথা শুনলেই রেগে যান।
তিনি বলেন, আর ১০ বছর হলে গাছগুলো বড় হতো। তখন গাছ বিক্রির টাকা দিয়ে ছেলেদের জন্য কিছু একটা করার পরিকল্পনা ছিল। রোহিঙ্গাদের কারণে এখন সব শেষ হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় বাজারে রোহিঙ্গাদের দেয়া ত্রাণের চাল, ডাল ও তেল স্বল্পমূল্যে পাওয়া গেলেও মাছ, মাংস ও সবজিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে। এ সংকট কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুদ করে রাখছেন। ফলে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। এ ছাড়া স্থানীয়দের এখন এলাকায় চলাফেরা করতে গিয়ে নিজেদের ‘রোহিঙ্গা নয়’ বলে প্রমাণ দিতে হয়। বিষয়টিও তাদের জন্য পীড়নের।
লিয়াকত আলীর মতোই রোহিঙ্গাদের ওপর ক্ষুব্ধ কুতুপালংয়ের যুবক হেলালউদ্দিন। তিনি বলেন, সাংবাদিক ও এনজিওগুলো শুধু রোহিঙ্গাদের খোঁজ নেয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার খোঁজ কেউ নেয় না। রোহিঙ্গাদের একসময় আমরা খাবার ও আশ্রয় দিয়েছি। এখন তাদের কারণে আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। চলতি মাসের ১ তারিখ রাতে ইয়াবা সেবন নিয়ে রোহিঙ্গা যুবকদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়। পরে রোহিঙ্গা, স্থানীয়রা ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশ বাদী হয়ে পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাত ৩০০ জনের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা করে।
এসব বিষয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সহসদস্য সচিব নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ক্যাম্পে সংঘাত বাড়ছে। ক্যাম্পে এখন যা ঘটছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষ হানাহানি, মামলা-হামলা মেনে নিতে পারি না। রোহিঙ্গাদের কারণে জনপ্রতিনিধিরা যেখানে নিরাপদ নয়, সেখানে আমরা সবাই শঙ্কিত ও আতঙ্কিত।