লন্ডন চালান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ত্রিরত্ন!

ঠিকানা রিপোর্ট : কী আশ্চর্য সমাপতন, যে ব্রিটিশরা একসময় প্রায় ২০০ বছর ভারত শাসন করেছে, তাদের দেশের রাজধানী লন্ডন এখন চালাচ্ছেন ভারতীয় উপমহাদেশেরই তিন রত্ন। যাদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার-নির্যাতন সয়েছেন যুগের পর যুগ, তাদেরই উত্তরসূরিরা আজ ব্রিটেনের ক্ষমতার মসনদে। এই ত্রিরত্নের একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত, একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এবং আরেকজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
প্রথমবারের মতো ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক, যা ব্রিটেনের ইতিহাসে নতুন দিক উন্মোচন করেছে। আর ঋষি সুনাকের মাধ্যমেই এথনিক কমিউনিটির কেউ ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। মাত্র ৪২ বছর বয়সে লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশ করলেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। অন্যদিকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান বর্তমানে লন্ডন শহরের মেয়র। লেবার পার্টির এই নেতা দুবারের নির্বাচিত মেয়র এবং লন্ডন শহরে বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত টাওয়ার হ্যামলেটের মেয়র বাংলাদেশের সিলেটের সন্তান লুৎফুর রহমান। তিনবার নির্বাচিত লুৎফুর লন্ডনের সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় মেয়র।
এটা দেখে অনেকেই বলছেন, এ এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। অনেকে বলছেন, এটা ইতিহাসের বদলা। প্রায় ২০০ বছর ভারত শাসন করার পর ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় দেশ ভাগ করে গিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের ভাগ হয়। তারপর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার মাত্র ৭৫ বছরের মাথায় এই তিন দেশের বংশোদ্ভূত তিন রাজনীতিকই এখন লন্ডনের রাজনীতির মাথায়।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। ঠিক যে রকমটা হয়েছিল ২০০৮ সালে বারাক ওমাবা যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঋষি সুনাকের আগেও অবশ্য এশিয়ানরা ব্রিটেনের রাজনীতিতে মন্ত্রী এবং মেয়র হয়েছেন। বেশ কিছু শীর্ষ পদেও তারা আসীন হয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর পদ পর্যন্ত কেউ পৌঁছাতে পারেননি।
তাই এখন সবার মুখে একজনেরই নাম, তিনি হচ্ছেন ঋষি সুনাক। ২০১৫ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রথমবার পার্লামেন্টের সদস্য হন মি. সুনাক। এর মাত্র ৭ বছরের মধ্যেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। মাত্র দেড় মাসের মাথায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস পদত্যাগ করায় গত ২৪ অক্টোবর ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন ঋষি সুনাক। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। ঋষি সুনাক এর আগে ব্রিটেনের অর্থবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফলে ব্রিটেনের ইতিহাসে এই প্রথম একজন ব্রিটিশ এশিয়ান রাজনীতিক প্রধানমন্ত্রী হয়ে ব্রিটেনের ১০ নং ডাইনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করতে সমর্থ হলেন। মাত্র ৪২ বছরের মি. সুনাক হলেন ব্রিটেনের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী এবং ১৮১২ সালের পর থেকে সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী।
ঋষি সুনাকের বাবা যশবীর ও মা ঊষা দুজনেরই জন্ম ভারতের পাঞ্জাবে। ভালো কাজের সুযোগে আর পড়াশোনার জন্য তারা বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। যশবীর সুনাক ব্রিটেনে একজন জিপি (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) ডাক্তার হিসেবে ও ঊষা সুনাক ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। মেধাবী ছাত্র সুনাক আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমবিএ করেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুনাক ব্রিটেনের চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার (অর্থমন্ত্রী) হন। সুনাকের আরেকটা পরিচয় হলো, তিনি ভারতের বিখ্যাত শিল্পপতি ও ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা এন আর নারায়ণমূর্তির জামাতা। নারায়ণমূর্তির কন্যা অক্ষতা মূর্তির সঙ্গে তার আলাপ স্ট্যানফোর্ডেই, পরে তারা দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। অক্ষতা মূর্তির সঙ্গে ঋষি সুনাকের বিয়ে হয় ২০০৯ সালে। ভারতের বেঙ্গালুুরু শহরে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। সুনাকের ৭৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পত্তি আছে, তার বেশির ভাগেরই মালিক তার স্ত্রী। তাই সবচেয়ে ধনী এই প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে বিশ্বে আলোচনার শেষ নেই।
এদিকে ২০২১ সালের মে মাসে লন্ডনের মেয়র হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন লেবার পার্টির নেতা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৫২ বছর বয়সী সাদিক খান। কনজারভেটিভ পার্টির সাউন বেইলিকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। প্রথম দফার ভোটে দুজনের কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফার ভোট গ্রহণ হয়। সেখানে ৫৫.০২ শতাংশ পপুলার ভোট পান সাদিক খান। সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য সাদিক খান যখন ২০১৬ সালে প্রথম লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন, তিনি ছিলেন কোনো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের রাজধানী শহরের প্রথম মুসলমান মেয়র।
অন্যদিকে চলতি বছরের ৫ মে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে মেয়র পদে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লুৎফুর রহমান। নির্বাচনে ‘টাওয়ার হ্যামলেট ফার্স্ট’ গ্রুপের প্রার্থী হিসেবে লেবার পার্টির জন বিগসকে হারিয়ে নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৫ সালে সিলেটে জন্ম নেওয়া লুৎফুর রহমান ২০১০ ও ২০১৪ সালে দুবার সরাসরি ভোটে টাওয়ার হ‌্যামলেটস বারার মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলেও ২০১৫ সালে আদালতের রায়ে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।