লাইফসার্পোট স্বাভাবিক জীবনের বিকল্প নয়! — মুহম্মদ শামসুল হক

বর্ষপরিক্রমার ডানায় ভর করে আবারও মহান একুশে ফেব্রæয়ারি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বদেশে ও প্রবাসে বিশ্ব বাঙালির দ্বারের কড়া নাড়ছে। মহান একুশের রক্তঝরা পথ বেয়েই উনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মোৎসর্গ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। আবার বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের সূতিকাগার হিসেবেও একুশে ফেব্রæয়ারির তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিশ্ব বাঙালির জীবনে অপরিসীম। তাই জাতিসংঘভুক্ত অপরাপর দেশের বাসিন্দাদের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষী মাত্রই ঐতিহ্যগতভাবে স্বদেশে ও প্রবাসে বিভিন্ন কর্মসূচি ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে মহান একুশে ফেব্রæয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে থাকে। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি, বেসরকারি, একক ও সমষ্টিগত উদ্যোগে শহীদ বেদিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভা এবং শহীদদের আত্মার চিরপ্রশান্তি এবং বিশ্ববাসীর কল্যাণ কামনায় বিশেষ প্রার্থনারও আয়োজন করা হয়ে থাকে।
এদিকে নিউইয়র্ক থেকে বর্তমানে প্রকাশিত প্রায় দেড় ডজন বিনা মূল্যের পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মাঝেই নব্বইয়ের দশকে বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত নিয়মিত সাপ্তাহিকী ‘ঠিকানা’ উনত্রিশতম বর্ষে পদার্পণ করবে এবারের মহান একুশে ফেব্রæয়ারি তারিখে। প্রায় আড়াই যুগের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও নিরলস প্রচেষ্টার সফল প্রাপ্তি হিসেবে ঠিকানার এখন একাদশে বৃহস্পতি কিংবা ষোলোকলা পুরা শশীর অবস্থানেই থাকার কথা। অথচ নানা কারণে নিউইয়র্কের প্রিন্ট মিডিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভের পরিবর্তে বর্তমানে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। অন্যান্য উৎস থেকে অর্জিত অর্থ এবং বিজ্ঞাপনের নামমাত্র আয়ে মুদ্রণ এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় কায়ক্লেশে মেটানো গেলেও প্রকৃত প্রস্তাবে বর্তমানে নিউইয়র্কের প্রিন্ট মিডিয়াকে স্যালাইন ও কোরামিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চলছে বললে অত্যুক্তি হয় না। অনেকের মতে, বিজ্ঞাপনদাতাদের দয়াদাক্ষিণ্য প্রদর্শনের মতো লাইফসাপোর্ট সরিয়ে নেওয়ামাত্রই বিনা মূল্যের সিংহভাগ পত্রিকার স্বখাতসলিল রচিত হবে। অথচ উপাসনালয় থেকে গ্রোসারি পর্যন্ত সর্বত্র বিনা মূল্যের পত্রপত্রিকার অযতেœ-অবহেলায় স্ত‚পাকারে ফেলে রাখার আত্মঘাতী প্রতিদ্ব›িদ্বতা পুরোদমে অব্যাহত রয়েছে। এই আত্মহনন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে বিনা মূল্যের পত্রপত্রিকা হিন্দুদের মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয়ের আঙিনাসহ সিটি প্রশাসনের বর্জ্য নিক্ষেপের স্থানগুলোও দখল করে নেবে বলে কেউ কেউ অভিমত পোষণ করছেন।
ঠিকানার প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সাংসদ এম এম শাহীনের বর্ণনানুসারে, নব্বইয়ের দশকে নিউইয়র্ক থেকে বাংলা ভাষার প্রথম নিয়মিত সাপ্তাহিকী ঠিকানার আত্মপ্রকাশ ছিল নিতান্তই সময়ের দাবি এবং ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটির অনস্বীকার্য চাহিদা। দেশের সঙ্গে প্রবাসের সেতুবন্ধ রচনা, ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রবাসী বাংলাদেশিদের পারস্পরিক সংযোগ বজায়, অস্তিত্ব ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুসংহত করা, শিল্প-সাহিত্য চর্চার অনুক‚ল ক্ষেত্র রচনা, মূলধারার রাজনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি এবং সামগ্রিক উত্থানের সোপান তৈরি করার লক্ষ্যেই নিউইয়র্ক থেকে সাপ্তাহিক ঠিকানার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি। যাত্রা শুরুর পর থেকেই অসংখ্য প্রতিক‚লতার মাঝেও ঠিকানা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে অকুতোভয়ে নির্জলা সত্য প্রকাশের মাধ্যমে সর্বস্তরের পাঠকদের সন্তুষ্টি বিধানের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন এবং অন্যায়ের নিকট মাথা নত না করার প্রদত্ত প্রতিশ্রæতি পূরণে ঠিকানা কতটুকু সফল বা ব্যর্থ হয়েছে, প্রতিক‚লতার মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে এবং প্রতিহিংসার পর্বতপ্রমাণ প্রাচীর ডিঙিয়ে ঠিকানার ২৯তম বর্ষে পদার্পণই তার যথার্থ প্রমাণ বহন করছে।
ঠিকানার সম্পাদকমÐলীর চেয়ারম্যান জনাব শাহীনের বক্তব্য অনুসারে : নিয়মিতভাবে ঠিকানা প্রকাশ ও বাজারজাত করতে গিয়ে জনাব শাহীনের বড় ভাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চৌকস অ্যাথলেট জনাব সাঈদ-উর-রবকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, নিজেদের শ্রম-ঘামে প্রতিষ্ঠা করা কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিক্রি করতে এবং পরিবারের অপরাপর সদস্য এবং ঘনিষ্ঠজনদের অমানুষিক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অধিকন্তু বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করার দায়ে আইন-আদালতের ঝক্কি পোহানোসহ নানা ধরনের হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া ছাড়াও মাঝে মাঝে নিতান্ত আপনজনদেরও বিরাগভাজন হতে হয়েছে। সর্বোপরি নানা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতি বারবার ঠিকানার ভিত্তিমূলে মরণ আঘাত হানতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি বলে তিনি দাবি করেন। তবে আশার কথা, ঠিকানার অকৃত্রিম দরদি পাঠকমহল এবং স্বল্পসংখ্যক পরম হিতৈষী সুখে-দুঃখে ঠিকানা কর্তৃপক্ষের পাশে হিমালয়ের মতো অটল-অচল থেকে ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলায় তাদের প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন। বরাবরের মতো এবারও ঠিকানা কর্তৃপক্ষ সশ্রদ্ধ ও অকপট চিত্তে এসব পরম হিতৈষীর অবদানকে স্মরণ করছে।
সময়ের অগ্রযাত্রা এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার মানুষের ধ্যানধারণা, মেধা-মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অহর্নিশ সর্বাধুনিকতার প্রলেপ মুড়িয়ে দিচ্ছে। তাই আমাদের চিরায়ত কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধও নানা ধরনের প্রতিক‚লতা ও হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। এমনতর বাস্তবতার নিরিখে বিগত ২৮ বছর ধরে সাপ্তাহিক ঠিকানা প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির বিবর্তন, বিকাশ ও বিনির্মাণে যথাসম্ভব গঠনমূলক অবদান রাখা সত্তে¡ও অনেকেই ঠিকানার প্রতি বর্তমানে অকৃতজ্ঞ এমনকি কেউ কেউ কৃতঘœ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন। এটি ঠিকানা কর্তৃপক্ষের কমিউনিটির কাছ থেকে আদৌ কাম্য ছিল না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশ্বের অপরাপর দেশের অভিবাসীদের মতোই আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনসহ নানামুখী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আটলান্টিকের এপারে প্রবাসী বাঙালিরা গোড়ার দিকে বসতি গড়েছিলেন। তবে অঢেল সুযোগ, অবাধ স্বাধীনতা ও বিলাসিতার ¯্রােতে গা ভাসাতে গিয়ে কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং আত্মপরিচিতহীন কোটি কোটি মিশ্র বর্ণের আমেরিকান সমাজে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও শিকড়চ্যুত ছিন্নমূল জাতিতে পরিণত হওয়ার পুরোপুরি আশঙ্কা ছিল। সেই নির্মম-রূঢ় বাস্তবতার নিরিখেই প্রবাসী বাংলাদেশি এবং তাদের নতুন প্রজন্মকে স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যমÐিত বাংলাদেশি হিসেবে আমেরিকার মাটিতে টিকে থাকতে সাহায্য করার কামনা-বাসনা থেকেই সাবেক সাংসদ জনাব শাহীন ঠিকানা পত্রিকা প্রকাশের ঝুঁকি নিয়েছিলেন বলে জনান্তিকে প্রকাশ। অবশ্য আমেরিকায় নোঙর ফেলার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে শিকড়চ্যুতির রাহুগ্রাস এবং মেল্টিং পটের ভয়াল থাবা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মকে রক্ষাকল্পে চিরায়ত বাংলার সহ¯্র বছরের ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ বিভিন্ন মহল বিভিন্নভাবে গ্রহণ করেছিল। ফলে ক্রমবর্ধিষ্ণু বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও সমাজসেবী প্রবাসী বাংলাদেশিরা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও ধর্মচর্চার পাদপীঠ হিসেবে নানা ধরনের উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় ধর্মীয়, বিনোদনমূলক ও সমাজসেবামূলক কর্মকাÐের পাশাপাশি ঘরোয়া পরিবেশে সঙ্গীত-নৃত্য ও সাহিত্যচর্চার আয়োজন করত। তবে ঠিকানার আত্মপ্রকাশ প্রবাসে শিল্প ও সাহিত্যচর্চা, পারস্পরিক যোগাযোগ ও ভাবের লেনদেন এবং দেশের সঙ্গে প্রবাসের সেতুবন্ধ রচনায় রাতারাতি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। আত্মপ্রকাশের লগ্ন থেকে ঠিকানা আমেরিকার প্রতিক‚ল পরিবেশে সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাÐ, কাব্য-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় সহায়তার পাশাপাশি বাংলাদেশের মহান একুশে ফেব্রæয়ারি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনে প্রয়োজনীয় ভ‚মিকা রেখেছে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের একই সুতার গ্রন্থিতে আবদ্ধের গুরুদায়িত্বও পালন করে আসছে। ঠিকানা প্রবাসী কবি-সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিকদের লেখা নিয়মিত প্রকাশের মাধ্যমে তাদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশে সহায়তা করে আসছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ফলে বর্তমানে অনেক স্বনামধন্য প্রবাসী কবি-লেখক-ঔপন্যাসিক বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছেন এবং কেউ কেউ একুশে পুরস্কারসহ বিভিন্ন ধরনের আকাশ আড়াল করা গৌরবও অর্জন করছেন। ভাষার মুনশিয়ানা, বর্ণনাশৈলীর ওজস্বিতা এবং বাক্য বিন্যাসের পারদর্শিতায় প্রবাসী অনেক লেখকই বর্তমানে বিশ্বমানের লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিকদের স্থান দখল করেছেন। তাছাড়া একুশের বইমেলাসহ সারা বছরই প্রবাসী কবি-সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিকদের বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে সাড়ম্বরে।
লোকপ্রবচন অনুসারে, বাঙালিরা স্বভাবতই রাজনৈতিকমনস্ক ও সংগঠনপ্রিয়। তাই প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনৈক্য ও অনাসৃষ্টি বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও বাংলাদেশিদের অনেকগুলো সংগঠন সমগ্র আমেরিকায় গজে উঠেছে অকল্পনীয়ভাবে। আর পান থেকে চুন খসে পড়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মান-অভিমান, কোর্ট-কাছারি ইত্যাদি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনাচরণের অন্যতম ভ‚ষণে পরিণত হয়েছে। আবার কিছুসংখ্যক স্বঘোষিত মোড়ল ও নেতা প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনৈক্য ও বিভাজনকে উসকে দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আত্মপ্রতিষ্ঠার স্থলে আত্মঘাতী প্রতিহিংসার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভক্তি এবং দ্ব›দ্ব বর্তমানে এতই তুঙ্গে উঠেছে যে নিজ নিজ দলীয় বলয়ের বাইরে কেউ পদ সঞ্চালন করতে রাজি নয় এবং ন্যূনতম সৌজন্যমূলক কুশল বিনিময় বা খোঁজখবর নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে।
প্রিন্ট মিডিয়া জগতের অবস্থা যে আরও বেহাল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনস্বীকার্য যে একুশ শতকের মাহেন্দ্রক্ষণে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জয়জয়কার প্রিন্ট মিডিয়ার বিপরীতে অবস্থান করছে। অথচ প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত অনেকেই বর্তমানের চরম যুগসন্ধিক্ষণেও আত্মোপলব্ধির পথ মাড়াতে নারাজ। আবার কেউ কেউ নিজেদের প্রকৃত পেশাকে আড়ালের অভিপ্রায়ে মোটা অঙ্কের অর্থের শ্রাদ্ধ করছেন বিনা মূল্যের পত্রিকা প্রকাশের পেছনে। তাদের অনেকে রাজা-উজির মারার ঢঙে বিভিন্ন সমাবেশে ও লোকসমাজে প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা নিয়ে দম্ভোক্তিও করে থাকেন। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠিত দৈনিকের নিউইয়র্ক সংস্করণও বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। কী কারণে বা কমিউনিটিকে কী ধরনের পরিষেবা দেওয়ার নিমিত্তে তাদের এই উদ্যোগ, তা অনেক প্রবাসীর মতো আমারও বোধগম্য নয়। অনেকের মতে, যারা বিগত ৩০-৩৫ বছর ধরে কায়ক্লেশে নিউইয়র্কের প্রিন্ট মিডিয়াকে টিকিয়ে রেখেছে দেশীয় দৈনিকের প্রবাস সংস্করণ তাদের দুর্ভোগের বোঝার ওপর শাকের আঁটি চাপিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য প্রবাস কমিউনিটিতে তাদের সে উদ্যোগ সাড়া জাগাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
উল্লেখ্য, যে বুকভরা আশা নিয়ে বাংলাদেশিরা শ্বাপদসঙ্কুল পথ মাড়িয়ে ও তরঙ্গবিক্ষুব্ধ আটলান্টিক সাঁতরে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন ও বসতি গড়েছিলেন তাদের সেই স্বপ্নসৌধ বর্তমানে বিপন্ন হওয়ার উপক্রম। ঘৃণ্য রাজনৈতিক মোহ, প্রতিশোধপরায়ণতা ও প্রতিহিংসা সাবেক শান্তিপ্রিয় প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটিকে উচ্ছন্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিহিংসা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও বিভক্তি বর্তমানে এতই ভয়াল রূপ ধারণ করেছে যে ইতোমধ্যে আয়- ব্যয়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বহু বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গণেশ উল্টিয়েছে এবং কেউ কেউ মোটা অঙ্কের দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত জীবন কাটাচ্ছেন।
যা হোক, মেঘে মেঘে বেলা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। ৩ দশকের ব্যবধানে প্রিন্ট মিডিয়া বিশাল মহিরুহে পরিণত হওয়ার পরিবর্তে অস্থিচর্মসার ও রক্তশূন্য চারাগাছই রয়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্যালাইন ও কোরামিন কিংবা লাইফসাপোর্ট দিয়ে মুমূর্ষু রোগীকে সাময়িকভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়; সুস্থ-সবল-স্বাভাবিক ও দীর্ঘ জীবন দান করা যায় না। তদ্রƒপ বিজ্ঞাপনের নামমাত্র আয় কিংবা রক্ত ঝরানো শ্রম-ঘামে অর্জিত অর্থ দিয়ে নিউইয়র্কের প্রিন্ট মিডিয়ার হাড্ডিসার দেহে রক্ত সঞ্চালন করা কিংবা একে দীর্ঘ দিন টিকিয়ে রাখা কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না। অন্যান্য বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো প্রিন্ট মিডিয়াকেও টিকে থাকতে হবে নিজস্ব আয়-উপার্জন, অর্থনৈতিক ভিত ও শক্তি-সামর্থ্যরে ওপর ভর করে। পরাশ্রয়ী জীবনযাপনের ন্যায় অন্যের দয়াদাক্ষিণ্য ও অনুকম্পার ওপর ভর করে প্রিন্ট মিডিয়া পরিচালনা সন্দেহাতীতভাবে দুরপনেয় কলঙ্ক বৈকি! তাই প্রিন্ট মিডিয়াকে স্বমহিমায় টিকিয়ে রাখতে হলে মালিক, সম্পাদক ও কর্তৃপক্ষের সমন্বিত ও সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। বিষয়টি সংবাদপত্রের মালিক, প্রকাশক ও সম্পাদকগণ যত দ্রæত হৃদয়ঙ্গম করবেন, ততই শুভ। অন্যথা প্রিন্ট মিডিয়া বাণিজ্যে লালবাতি জ্বলার পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের মান-ইজ্জতও ভ‚লুণ্ঠিত হতে বাধ্য।
২৯তম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে ঠিকানার পরম হিতৈষী ও শুভাকাক্সক্ষী মহল এবং সহযোদ্ধাদের জানাচ্ছি উষ্ণ ও রক্তিম শুভেচ্ছা। অন্যদিকে যারা নিজস্ব মেধা-মনন ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে ঠিকানাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, বিজ্ঞাপন দিয়ে আর্থিকভাবে সহায়তা করে কৃতজ্ঞতার ডোরে আবদ্ধ করেছেন, সর্বোপরি সৃজনশীল লেখনী এবং ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে ঠিকানার সাহিত্যানুরাগী পাঠকদের অতৃপ্ত আত্মার হাহাকার নিবৃত্ত ও স্মৃতিভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু এবং পরলোকগতদের আত্মার চিরপ্রশান্তি ও ঠিকানার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার কাজে সবার ঐকান্তিক সহযোগিতা কামনা করছি।
সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ১৮ ফেব্রæয়ারি ২০১৮।