
ঠিকানা ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রে দ্রব্যমূল্যের দাম লাগামছাড়াই বাড়ছে। ফলে মানুষের আয়ের সাথে ব্যয়ের বেশ গড়মিল তৈরি হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ১৯৭০-এর পর থেকে কখনো এতটা বাড়েনি। গ্রোসারি শপে যেসব জিনিসপত্র বিক্রি হয়, সেগুলোর দাম গত এক বছরে প্রায় ১৩.৫ শতাংশ বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে তাল মেলাতে পারছে না বেশির ভাগ মানুষ। এই সময়টাকে খুবই কঠিন সময় বলে অনেকেই মনে করছেন। সামনে মধ্যবর্তী নির্বাচন আসছে। জিনিসপত্রের যেভাবে দাম বাড়ছে, তাতে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যারা ভোট দিয়েছিলেন, নির্বাচনের পর থেকে মানুষের অসন্তুষ্টি বেড়েই চলেছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে- এক ডজনের ডিমের কার্টন যা ছিল ৯৯ সেন্ট থেকে দুই ডলার, তা বেড়ে এখন তিন ডলারেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। চাল-আটা-ময়দা, মাছ-মাংস, শাক-সবজি, পিয়াজ-রসুন-আদার দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশেরও বেশি। অথচ ২০২১ সালে ডেমোক্র্যাটরা যখন ক্ষমতায় আসে, তখনও এসব জিনিসপত্রের দাম বর্তমানে চেয়ে প্রায় অর্ধেক ছিল। এক গুচ্ছ কলার দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
এদিকে আমেরিকানরা ধারাবাহিকভাবে বলছে, অর্থনীতি এবং মূল্যস্ফীতি তাদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপর অসন্তুষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে তার প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা আরো বেশি অসন্তুষ্ট। ‘তিনি ভালো কাজ করেননি’ বলছিলেন টেক্সাসে বসবাসরত ৩৬ বছর বয়সী রোমিশা লোয়ারি। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক ভোটার।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য, গ্যাস এবং অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাবার কারণে তার পরিবার ফুড প্যান্ট্রিতে গিয়ে সাহায্য চাইতে হয়েছে। গত দুই বছরে আমার মনে হচ্ছে, ট্রাম্পের সময় আমরা যতটা গরিব ছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি গরিব হয়ে গেছি’ বলেন রোমিশা লোয়ারি।
দাম কমানোর জন্য জো বাইডেন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। গ্যাসের দাম কমিয়ে আনার জন্য আমেরিকার তেলের রিজার্ভ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল ছাড় দিয়েছেন তিনি। এটা অভূতপূর্ব। খাদ্য-পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন মাংসের বাজারে প্রতিযোগিতার বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি কৃষকরা যাতে সার কিনতে পারে, সেজন্য তাদের সহায়তা বাড়ানো হয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা তথাকথিত ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট ২০২২’ পাস করেছে।
দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য আইন প্রণয়নের মতো পদক্ষেপ হয়তো রাজনৈতিকভাবে ভালো হতে পারে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন আইন প্রণয়ন করে মূল্যস্ফীতির কোন প্রভাব পড়বে না। অন্যদিকে, রিপাবলিকানরা মূল্যস্ফীতির বিষয়টিকে তাদের বিজয়ের জন্য একটি ইস্যু হিসেবে দেখছেন।
নেব্রাস্কার রিপাবলিকান প্রতিনিধি একটি বিজ্ঞাপন বানিয়েছেন। সেখানে দেখানো হচ্ছে যে তিনি তার স্ত্রীকে ‘বাইডেন বার্গার’ দিচ্ছেন। এটি ছোট আকারের, কিন্তু উচ্চ মূল্যের একটি বার্গার। দ্রব্যমূল্য কোথায় গিয়ে ঠেকেছে- সেটি বোঝানোর জন্য তিনি এটির নাম দিয়েছেন ‘বাইডেন বার্গার’।
দ্রব্যমূল্য বাড়ার নেপথ্যে : প্রথমত জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে করোনাভাইরাস মহামারির সময়। যখন মানুষের রেস্টুরেন্টে খাওয়া ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল এবং মুদি দোকানের জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ে। তাছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির কারণে উৎপাদন ব্যবস্থাও ব্যহত হয়।
উৎপাদনের জন্য কোম্পানিগুলোর যে অতিরিক্ত খরচ হয়, সেটি তারা ভোক্তাদের উপর ঠেলে দিয়েছে। যেমন তাদের মজুরি বাড়াতে হয়েছিল এবং জ্বালানির দাম আগের তুলনায় বেড়েছে।
এরপর চলতি বছরে যখন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে সার, গম এবং অন্যান্য শস্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। খারাপ আবহাওয়ার কারণে শস্যের উৎপাদন ব্যহত হয়েছে। অন্যদিকে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার জন্য ডিমের সরবরাহ কমে যায়।
মধ্যবর্তী নির্বাচন : ডেমোক্র্যাটদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা!
আগামী নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে কংগ্রেস কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং অনেক অঙ্গরাজ্যের নেতৃত্ব ঠিক হবে। তবে এই নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ কম থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো চেষ্টা করে তাদের মূল সমর্থকদের ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করতে। সাধারণত প্রেসিডেন্টের দল মধ্যবর্তী নির্বাচনে আসন হারায়। তবে ডেমোক্র্যাটরা মনে করছে, তারা যতটা আশংকা করেছিল, নির্বাচনের ফলাফল ততোটা খারাপ হবে না। যদিও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাদের বিপক্ষে। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার প্রতিযোগীও কম।
ডেমোক্র্যাটদের শক্ত ঘাঁটিগুলোতে গর্ভপাত বিতর্কে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি কিছুটা চাপা পড়েছে। গর্ভপাত করার যে সাংবিধানিক অধিকার, সেটি সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেবার পর আলোচনায় এসেছে। এছাড়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়েও উদ্বেগ আছে। রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পৃক্ত হবার পর থেকে এটি তৈরি হয়েছে। রিপাবলিকানদের জন্য অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া। এছাড়া রিপাবলিকান প্রার্থীরা ইমিগ্রেশনের বিষয়টিকেও সামনে আনছে। ‘শুধু গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিকে সামনে এনে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’-বলেছেন জনমত জরিপ বিশ্লেষক লি মিরিঙ্গফ। ‘মানুষের ধারণা পরিবর্তন হয়ে যায়। সেজন্য আপনি শুধু একটি ইস্যুর উপর ভিত্তি করে প্রচারণা চালাতে পারে না’ বলেন মি. মিরিঙ্গফ।
জনমত জরিপে দেখা গেছে, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নির্ভর করে রাজনৈতিক পক্ষপাতের উপর। মি. মিরিঙ্গফ বলেন, অনেক ভোটার এরই মধ্যে তাদের মনস্থির করে ফেলেছে। তিনি মনে করেন, ভোটারদের মনোভাব খুব একটা পরিবর্তন দেখা যাবে না।
বিশ্ববাজারে কমেছে চিনি-মাংস-দুধের দাম, বেড়েছে ধান-গমের : জাতিসংঘ : গত ছয় মাসে বিশ্বজুড়ে চিনি, মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের মূল্য খানিকটা কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে ধান-গম-ভুট্টার মতো খাদ্যশস্যের দাম। তবে সার্বিক বিচারে ধীরে ধীরে খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (ফাও) বৈশ্বিক খাদ্যপণ্য মূল্যসূচকের সেপ্টেম্বর মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে এই তথ্য।
গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাঁধার পর বিশ্বজুড়ে ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়েছিল খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল, চিনি, মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাতপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম।
খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণে ১৯৬২ সাল থেকে ব্যবহার করে আসছে ফাও। যুদ্ধ শুরুর পর চলতি বছরের মার্চ মাসে সেই সূচক ঠেকেছিল রেকর্ড ১৫৯ দশমিক ৭ পয়েন্টে; এর অর্থ খাদ্যপণ্যের বাজারমূল্য দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। ফাও’র পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়েছিল, গত ৬০ বছরের ইতিহাসে এত অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দামের এই পরিমাণ উল্লম্ফণ ঘটেনি।
তার পরের মাস থেকেই অবশ্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে দাম। ফাও’র বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসে বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচকের অবস্থান অবস্থান ছিল ১৩৬ দশমিক ৩ পয়েন্টে। তার আগের মাস আগস্টে সূচকের অবস্থান ছিল ১৩৭ দশমিক ৯ পয়েন্টে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে বিশ্বে কমে আসছে খাদ্যপণ্যের দাম।
সূচক বিশ্লেষণ করে আরো জানা গেছে, শতকরা হিসেবে গত ছয় মাসে বিশ্বে ভোজ্য তেলের দাম কমেছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ; আর চিনি, মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের মূল্য ১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে চাল ও গমের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ করে এবং ভুট্টার দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খরা, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে উৎপাদন কম হওয়াই এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ।
ফাও থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বর্তমান বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে, কমেছে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম। যদি খাদ্যশস্যের দাম স্থিতিশীল থাকত, বাজারে আরো স্বস্তিভাব বজায় থাকত।’