প্রণবকান্তি দেব : পুরো গল্পটা আনন্দ-বেদনার মিশেলে পূর্ণ। আছে একই সাথে গৌরব এবং হতাশাও। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা কেউ হারিয়েছেন ভাই, কেউ বাবা, আবার কেউ সন্তান। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাদের। এরপর আর কোনো সন্ধান মেলেনি। দেশ স্বাধীনের পর ৫২ বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের সমাধি খুঁজে ফিরেছেন তারা। কিন্তু মেলেনি কোনো সন্ধান। তারা শুধু জানতেন একটি স্বাধীন দেশের জন্য তারা আত্নাহুতি দিয়েছেন। সম্প্রতি মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া এমন ৬৬ জনের গণকবর খুঁজে সেখানে ‘সিলেট শহিদ স্মৃতি উদ্যান’ নির্মাণ করা হয়েছে। গত ৪ মার্চ শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ উদ্যানের উদ্বোধন করা হয়েছে। উদ্বোধন করেন শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ও মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খানসহ শহিদ স্বজনরা। শহিদ স্বজনদের সম্মাননা জানানোর পাশাপাশি, আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে। আর এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুস সালাম বীরপ্রতীক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী চিকিৎসক মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমদ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিলেট এরিয়া কমান্ডার এবং সিলেট ক্যাডেট কলেজের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত এ প্রকল্পের আরেক সদস্য মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মা। আর পুরো কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়েছে বিশ্ব সিলেট সম্মেলন কমিটির তত্ত্বাবধানে।
এ প্রকল্পের গবেষকদলের প্রধান মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মা জানান, ১৯৭১ সালে সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী সালুটিকর এলাকার সিলেট ক্যাডেট কলেজে ক্যাম্প গড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাসহ বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করা হতো এখানে। হত্যার পর ক্যাডেট কলেজের পেছনেই গণকবর দেওয়া হয় তাদের। এখানে অন্তত ২০০ বাঙালিকে গণকবর দেওয়া হয় বলে ধারণা করা হয়। তিনি জানান, দীর্ঘদিন থেকে এ গণকবর নিয়ে গবেষণার পর সিলেটের সালুটিকরের এ বধ্যভূমিতে শহীদ ৬৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে।
অপূর্ব শর্মা জানান, সালুটিকরের এই গণকবরটি সবার কাছেই বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত থাকলেও এতদিন এটি পড়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এই টিলাভূমি। ছিল না কোনো স্মৃতিচিহ্নও। সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় এই বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল না। অবশেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
শহীদ স্মৃতি উদ্যানের বিশাল চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। একটি স্তম্ভে রয়েছে এখানে শায়িত সব শহীদের নাম। এছাড়া সব শহীদের নামখচিত আলাদা স্মৃতিফলকও রাখা হয়েছে। ফুল আর গাছে গাছে আচ্ছাদিত পুরো চত্বরের বিভিন্ন স্থানে এই উদ্যান নির্মাণের পটভূমি, এখানে শায়িত সব শহীদের জীবনী লেখা রয়েছে। এই স্মৃতি উদ্যানে পাঠাগার, জাদুঘর, কফিশপ এবং আলাদা বসার জায়গা নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
উদ্যোক্তাদের অন্যতম বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা কেবল মুখে বলি ৩০ লাখ শহীদ। কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা নেই। কাকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে, কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে কেউ জানে না। আমরা এসব খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। সে লক্ষ্যে সালুটিকর বধ্যভূমিকে উদ্যান করার উদ্যোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘এটা কেবল কবরস্থান নয়, আমাদের ইতিহাসেরও অংশ। তাই এটিকে সেভাবেই নির্মাণের চেষ্টা করেছি। এখানে এসে মানুষজন কেবল কষ্ট পাবে না, জানতে পারবে এবং আনন্দ পাবে। তিনি বলেন, দেশ এবং প্রবাসের অনেকের সহযোগিতায় এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে।
এ উদ্যানে এখন পর্যন্ত যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তারা হলেন, নারায়াণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার মোসলেহ উদ্দিন ভুঁইয়ার ছেলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ড. এএফ জিয়াউর রহমান, হবিগঞ্জ জেলার আউশকান্দি এলাকার সৈয়দ সাজিদ আলীর ছেলে সৈয়দ সিরাজ আবদাল, সিলেট নগরীর পুরানলেন এলাকার উপেন্দ্র কিশোর সেনগুপ্তের ছেলে বিমলাংশু সেন, ছড়ারপাড় এলাকার আব্দুন নুরের ছেলে বাছির মিয়া, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দেউল গ্রামের মন্তাজ আলীর ছেলে নুরুল হুদা গউস, ইপিআর ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন, সিলেট নগরীর মুগলটুলা এলাকার মশরফ আলীর ছেলে সোনাওর আলী, মিরাবাজার এলাকার শারদাচরণ দেবের ছেলে শুভেন্দু শেখর দেব শংকর, একই এলাকার গিরিধারী চক্রবর্তীর ছেলে গির্বানী কান্ত চক্রবর্তী, তার ছেলে গকুলানন্দ চক্রবর্তী ও গঙ্গোত্রী চক্রবর্তী।
এছাড়া অন্যরা হলেন, খাদিমপাড়ার দত্তগ্রাম এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে সিদ্দিক আলী, একই গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে আব্দুর রব হীরা, মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার খলাগ্রামের সূর্যকুমার ধরের ছেলে সুরতিমোহন ধর, একই গ্রামের দীনরাম দেবের ছেলে নরেন্দ্র দেব, সিলেট মহানগরের জল্লারপাড় এলাকার বলেন্দ্র্র চন্দ্র রায়ের ছেলে শুভন্দ্র শেখর রায়, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ছোটদেশ এলাকার আছদ্দর আলীর ছেলে তোতা মিয়া, সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আনোয়ার পাত্রের ছেলে কুমেদ পাত্র, একই গ্রামের কানতুর পাত্রের ছেলে ফরছন পাত্র, রবাই মিয়ার ছেলে ইসরাইল আলী, সৈয়দ আলীর ছেলে আব্দুর রহমান, কনাই মিয়ার ছেলে আব্দুল গনি, মুছন আলীর ছেলে রমজান আলী, সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুল এলাকার হামিদ উল্লার ছেলে আমজদ আলী, সিলেট মহানগরের আখালিয়া ব্রাহ্মণশাসন এলাকার করুণাময় ভট্টাচার্যের ছেলে কালিপদ ভট্টাচার্য, তার ছেলে হীরেন্দ্র ভট্টাচার্য, নগরীর নয়াটিলা এলাকার সদাই নমঃশুদ্রের ছেলে সুখাই নমঃশুদ্র এবং সিলেট সদর উপজেলার উমদারপাড়া গ্রামের আলাই মিয়ার মেয়ে ছুরেতুননেছা। আরও যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন, একই গ্রামের ওয়াহাব উল্লার মেয়ে রহিমা বেগম ও খলিলা বেগম, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার খোজারখলা গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে তজমুল আলী, সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আব্বাস আলীর মেয়ে ময়না বিবি, গোয়াইনঘাট উপজেলার বীরকুলি গ্রামের ছমেদ আলীর ছেলে আব্দুল খালিক, সিলেট সদর উপজেলার লাখাউড়া গ্রামের হায়দার মিয়ার ছেলে আব্দুল মজিদ, একই উপজেলার পোড়াবাড়ি গ্রামের রামচরণ উড়াংয়ের সন্তান দূর্গা উড়াং ও ভাদুয়া উড়াং, একই গ্রামের লিব উড়াংয়ের সন্তান ঘাটমা উড়াং, একই উপজেলার বাবার হাট এলাকার কিশোরপাত্রের ছেলে শচীন্দ্রপাত্র, মহালদিক গ্রামের ছফর আলীর ছেলে আব্দুল গণি, সিলেট সদর উপজেলার লালবাগ এলাকার আব্দুল আলীর ছেলে জহির আলী, একই গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে জফুর আলী। সিলেট সদর উপজেলার বালিয়াকান্দি গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল ছোবহান, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি গ্রামের সৈয়দ আহমদের ছেলে আব্দুল আলী, সিলেট সদর উপজেলার জৈনকারকান্দি গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে সাজিদ আলী, একই উপজেলার বাউয়ারকান্দি গ্রামের সফর আলীর ছেলে আব্দুল গনি, গোয়াইনঘাট উপজেলার কচুয়ারপাড় গ্রামের উমেদ আলীর ছেলে আকবর আলী, একই গ্রামের ফুরকান আলীর ছেলে ইউসুফ আলী, সিলেট সদর উপজেলার দাফনাটিলা গ্রামের ইসরাইল আলীর ছেলে কুটি মিয়া, একই উপজেলার কালাগুল এলাকার কেয়ামত আলীর ছেলে সুরুজ আলী, সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর গ্রামের ফজল খানের ছেলে নুরুল হক খান, সিলেট সদর উপজেলার মহাজনপট্টি এলাকার গুরুচরণ মিত্রের ছেলে গজেন্দ্রলাল মিত্র, একই এলাকার মদনমোহন বণিকের ছেলে প্রাণ গোবিন্দ বণিক, শুধাংশু শেখর দত্তের ছেলে সুনীল দত্ত, সিলেট নগরীর সুবিদবাজার নয়াবস্তি এলাকার নারায়ন সিংহের ছেলে আনন্দ সিংহ, তার ছেলে খগেন্দ সিংহ, বড়বাজার রায়হোসেন এলাকর গরবা সিংহের ছেলে গৌরমোহন সিংহ, বিশ্বনাথ উপজেলার কর্মকলাপতি গ্রামের বৃন্দাবন চন্দ্র দেবের ছেলে বসন্ত কুমার দেব, সিলেট নগরীর তাঁতীপাড়া এলাকার বংকেশ দাশ, ওসমানীনগর উপজলার তাজপুর রবিদাশ এলাকার গজেন্দ্র কুমার দেবের ছেলে মিহির লাল দেব এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার নন্দনগর গ্রামের আব্দুল গণি চৌধুরীর ছেলে আব্দুল আহাদ চৌধুরী, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণবাঘার মসিউদ্দিন চৌধুরী ছেলে সাইফুদ্দিন চৌধুরী এবং ইপিআরের মেজর আব্দুল্লাহ, ক্যাপ্টেন খালেদ ও মেজর চৌধুরী। উদ্যানের অন্যতম উদ্যোক্তা কর্নেল (অব.) এম এ সালাম জানান, শহিদের প্রতি অন্তরের টান অনুভব করে আমরা এগিয়ে এসেছি। সবাইকে একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে যার যার সাধ্যমতো। এদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যান, সিলেট- উদ্বোধনের পর প্রশংসায় ভাসছেন উদ্যেক্তারা। সচেতন মহলের অভিমত, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুশীলনে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।