মোহাম্মদ জামান খোকন :
১৪ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বেদনাবিধুর দিবস। ১৯৭১ সালের এর এদিনে, বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে, আমরা আমাদের দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের হারাই। পাকিস্তানিরা সেই ৭১-এর মার্চ মাসেই সারাদেশে সাধারণ জনগণ, আমাদের সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সাথে সাথে তারা শিক্ষকদের ওপরও হামলা করে। সেই সময় প্রফেসর জিসি দেব, মনিরুজ্জামান, সরাফত আলী, ফজলুর রহমানসহ অনেক শিক্ষককে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে তারা তা বন্ধ করে। ২৫ মার্চের পর থেকে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ৭ মার্চের বক্তৃতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশ, ২৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, পাকিস্তান দিবসের বদলে প্রতিবাদ দিবস হিসাবে পালিত হয়। সারাদেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো হয়। এর পরেই আসে ২৫ মার্চ। বাংলাদেশের ঘুমন্ত মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করা হয়। পুলিশ বহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চের রাতের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পূর্বেই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে তা চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠিয়ে দেন। মান্নান সাহেব চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে সেই ঘোষণা পাঠ করেন।
২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ মুজিবনগর সরকার মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গতাজ তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। তিনি সারাদেশকে ৯টি সেক্টর কমান্ডে ভাগ করেন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যোগ্য উত্তরসুরী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে। তিনি তার যোগ্যতা, মেধা, প্রজ্ঞা, সাংগঠনিক তৎপরতা সর্বশক্তি দিয়ে প্রয়োগ করেন। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বহু রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা তথা বিজয় ছিনিয়ে আনেন বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধারা।
এবার আসি সেই বেদনাবিধূর দিনের কথায়। আমি একজন, যে মনেপ্রাণে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যাইনি বা যেতে পারিনি। যুদ্ধ শুরু ২দিন পর, যখন কুমিল্লা শহরে কার্ফু তুলে নেয়া হয়, তখন গ্রামের বাড়ি চলে যাই। আমাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা শহরের পূর্বদিকে ভারতীয় সীমান্তের শান্তিনগর গ্রামের পশ্চিম দিকে। সেটা ভারতের সোনামুড়া শহরের দক্ষিণ দিকে। ত্রিপুরা রাজ্য একসময় কুমিল্লা শহরের নামেও পরিচিত ছিল। অর্থাৎ কুমিল্লা জেলার নাম ছিল ত্রিপুরা জেলা। ১৯৬২ সালের দিকে কুমিল্লা জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এক সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গায়িকা মালা চৌধুরী ও তার বোন লতা চৌধুরীকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এরপর ভারতে পাঠাই।
তারপরে যখন বর্ডার এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্য চলে আসে, তখন গ্রাম নিরাপদ নয়। তাই আবার আমার দুলাভাই ড. আবদুল্লাহ (প্রাক্তন আইবিএম কর্মকর্তা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক ও মহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন। তিনি, আপা ও আমাদের ভাগ্নে কাজল আমাদের বাসায় ছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকায় চলে আসবেন। আমি ও বাবুল তাদের সাথে ঢাকায় চলে আসি।
ঐ মহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন গিয়াসউদ্দিন সাহেব। সেই হাউস টিউটর কোয়ার্টারে থাকতেন বজলুল হক খন্দকার (ব্যবস্থাপনা বিভাগ)। তিনি পরবর্তীতে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। সেখানেই গিয়াসউদ্দিন সাহেবের সাথে পরিচয়। একজন অমায়িক ব্যবহারের ভদ্রলোক। দরাজ কণ্ঠের অধিকারী। ভাই-বোনদেরকে বড় করেছেন। বিয়ে করেননি। একদিন দুলাভাই তার বাসায় গেছেন, আমি কাকে ডাকতে গেলাম। উনি ছিলেন দো’তলায় সি কোয়ার্টারে। দরজা খোলার সাথে সাথে তিনিই প্রথম আমায় সালাম দিলেন। জানতে চাইলেন কি চাই? বলাম আবদুল্লাহ সাহেবের কথা। তিনি দুলাভাইকে গিয়ে বললেন, আব্দুল্লাহ সাহেব, আপনার ছোট ভাই এসেছে, ঘরে যেতে বলেছেন। এসবই ৫০ বছর আগের কথা, এখনও ভুলতে পারি না। রসুল (সা.) সেই উপদেশ- ‘আগে যে সালাম দেয়, সে বেশি সওয়াব পায়’, তিনি সবসময় সেটা করতেন। হলে পানির সমস্যা, বা যেকোন সমস্যা হলেই তিনি চলে যেতেন। তার ছোট ভাই ডাক্তার ছিলেন। তাকেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত আনিসুজ্জামানের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আনিসুজ্জামানের বইয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে লেখা চিঠি আছে। আসলে ভাল লোক ভাল মানুষকে চিনতে পারে।
গিয়াস সাহেবের ছোট বোন টুকু (ডাকনাম), তখন গণিত বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষিকা নিযুক্ত হন। আরেক বোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। ছদ্মবেশ ধারণ করে কখনো দিনমজুর, রিকশাওয়ালার বেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। একদিন ছাত্র সংঘের (বর্তমান ছাত্রশিবির) কিছুলোক এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি গিয়েছিলেন হলের পানির পাইপ করার জন্য। এরপর তিনি আর কোনদিনই ফিরে আসেননি। এভাবেই আমরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হারাই। শহীদউল্লাহ কায়সার, তিনিও বাসায় অপেক্ষা করছিলেন। মায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করে বাসায় ছিলেন, চিন্তা করেছেন একদিন পরেই দেশ স্বাধীন হবে। হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা দেখে যেতে পারেননি। ঠিক তেমনিভাবে চক্ষু চিকিৎসক আলীম সাহেবকে আলবদর বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। সেই বাসার পাশের বাসায়ই মওলানা মান্নান থাকত। আলীম সাহেবের স্ত্রী অনেক অনুরোধ করেছেন, মান্নান বলেছেন, চিন্তা করবেন না। তারা তাকে ফেরৎ দিয়ে যাবেন। তার ছোট মেয়ে নুজহাত চৌধুরীও বাবার মত একজন বিজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসক।
যাক, আজ আবার সেই দিবস ফিরে এসেছে। সবার সম্মিলিত প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। তাদের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করছি, মহান রাব্বুল আমীন যেন তাদের জান্নাত নসীব করেন। সবশেষে সব মুক্তিযোদ্ধা ভাই-বোন, সম্ভ্রম হারানো মা-বোন, ভারতীয় বাহিনীর শহীদ সৈন্যদের জন্য দোয়া করছি। সৃষ্টিকর্তা যেন তাদের যোগ্যস্থান প্রদান করেন পর জগতে।
প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রতি আজকের এই দিনে আরজ, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন। বিচার কার্যক্রম ও রায় কার্যকরের ব্যবস্থা করুন। তখনই তাদের আত্মা শান্তি পাবে। আপনি সুস্থ থাকুন।
সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রার্থণা- তুমি তোমার ও রাসুলের পক্ষে চলার শক্তি দাও।
-পাকিপসী, নিউইয়র্ক।