শহীদ শিবচরণের সমাধি কি গুঁড়িয়ে দেয়া হবে

সিরাজগঞ্জ : একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার শিকার সিরাজগঞ্জের শিয়ালকোল গ্রামের শহীদ শিবচরণ রবিদাসের সমাধির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সওজের চার লেন সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সমাধিটি কি গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, নাকি স্থানান্তর করা হবেÑ কেউই নিশ্চিত করে তা বলতে পারছেন না।
সিরাজগঞ্জে চার লেন সড়কের জন্য সওজ এক সপ্তাহ আগে শিবচরণের সমাধিটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তাতে সফল হতে না পারলেও চার পুরুষ ধরে বসবাসরত শহীদ শিবচরণের অসহায় ও দরিদ্র স্বজনদেরও উচ্ছেদ করা হয়।
একজন শহীদের সমাধির অবমাননা ও তার পরিবারকে উচ্ছেদ করার মতো বিষয়টি সম্পর্কে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, সরকারি প্রশাসন, এমনকি স্থানীয় সাংসদও অবগত আছেন। তবে কেউই সমাধিটি রক্ষা বা শহীদ শিবচরণের স্বজনদের পুনর্বাসনে কোনো উদ্যোগ নেননি।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ জেলা শহর হয়ে পূর্বদিকে মালশাপাড়া কাটাওয়াপদা ও পশ্চিমে শিয়ালকোল ইউনিয়নের চ-ীদাসগাঁতীর সৈয়দ স্পিনিং পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার অংশে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেন সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কাজের জন্য রাস্তার পাশে আগে থেকেই সরকারি জায়গাও রয়েছে। আবার কিছু স্থানে নতুন করে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণও করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের সীমানার মধ্যে পড়েছে শহীদ শিবচরণের সমাধিসহ স্বজনদের আবাসস্থল। সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নে নির্মাণাধীন শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের সীমানা প্রাচীরে প্রায় দেড়শ মিটার পশ্চিমে ঝুপড়ি তুলে শহীদ শিবচরণের স্বজনরা চার পুরুষ ধরে বসবাস করে আসছিলেন।
শহীদ শিবচরণের সমাধির আশপাশে এক্সক্যাভেটর বা বেকু বসিয়ে গত পয়লা বৈশাখে সমাধি তুলে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সময় শহীদ শিবচরণের স্বজনরা এক্সক্যাভেটর বা বেকুর নিচে শুয়ে পড়লে এলাকাবাসীর তোপের মুখে বেকু চালক বাধ্য হয়ে সমাধি বাদ রেখে আশপাশে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করে চলে যান।
উচ্ছেদ করার পর শিবচরণের স্বজনেরা সমাধির ওপর একটি ছোট সাইনবোর্ড লাগিয়ে তাদের গৃহস্থালির জিনিসপত্র নিয়ে পাশে অন্যের জায়গায় খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য শহিদুল আলম ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউই তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেননি।
শেষ পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের নজরে আসে। শহীদ শিবচরণ রবিদাসের ছেলে মঙ্গল চন্দ্র রবিদাস বলেন, আমরা চার পুরুষ ধরে এখানে বাস করছি। আমার বাবা একাত্তরে নিহত হন। পরে তার দেহাবশেষ নিয়ে এসে এখানে সমাহিত করা হয়। আমরা সরকারের উন্নয়নের বাধা নই। তবে আমার বাবার সমাধি যেন নষ্ট না হয়। আমাদের উচ্ছেদ করায় আমরাও খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমাদের কোনো সহায়-সম্বলও নেই। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, বিষয়টি দ্রুত দেখা হোক।
শিয়ালকোল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ও শহীদ পরিবারের সদস্য শহিদুল আলম বলেন, শহীদ শিবচরণের সমাধির বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা না করেই ওই অংশে কাজ শুরু করে সওজের লোকজন। আমরা বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে এ এলাকার বাসিন্দা সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য সেলিনা বেগম স্বপ্না ও ইউএনওকে অবগত করি। তবে কেউই গত এক সপ্তাহে কোনো উদ্যোগ নেননি। শিয়ালকোল ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান শেখ গত ১৯ এপ্রিল দুপুরে বলেন, আমরা শহীদ শিবচরণের সমাধির বিষয় সদর ইউএনওসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়েছি।
তবে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার মোহাম্মদ রায়হান গত ২০ এপ্রিল সকালে বলেন, বিষয়টি আমি অবগত নই। একই মন্তব্য করেন সওজ স্থানীয় উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আনোয়ার পারভেজ ও নির্বাহী প্রকৌশলী ড. আহাদ উল্লাহ। তবে তারা বলেন, আজই আমরা বিষয়টি সরেজমিন দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
জেলা প্রশাসক ও খ-কালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কামরুন নাহার সিদ্দিকা বিষয়টি অবগত নন বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, উন্নয়নের স্বার্থে যেমন চার লেন সড়ক দরকার, তেমনি শহীদ সমাধিটি সংরক্ষণ করাও বিশেষ প্রয়োজন। স্থানীয় এমপি সাহেব বিদেশে আছেন। তিনি ফিরে এলেই আমি বিষয়টি দেখব।
সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য সেলিনা বেগম স্বপ্না বলেন, জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে অনুরোধ জানিয়েছি। শিগগিরই তিনি পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাসও দিয়েছেন। সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট কলামিস্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, শহীদ শিবচরণের সমাধি রক্ষা ও তার স্বজনদের পুনর্বাসনের জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।