
রওশন হক :
টিএসসি চত্বর অধিকার আদায়ের স্লোগানের স্থান, যেখানে সমাজের সকল অন্যায়-অবিচারের পতন চেয়ে বিবেক-জাগানিয়া আলাপ হয়। যুগে যুগে টিএসসির ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে মানুষের অধিকার আদায়ের মিছিল হয়েছে। মুক্তচিন্তার ভাষণ শুনে অন্যায়-অন্যায্যের বিরুদ্ধে স্লোগানে গলা মেলায় ছাত্রসমাজ। বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই অধিকার আদায়ের কেন্দ্রস্থল হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তন। সেখানে কাওয়ালি অনুষ্ঠান নিয়ে ঘটে গেল কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় চলছে নানা রকম আলোচনা।
কাওয়ালি একপ্রকার আধ্যাত্মিক প্রেমবিষয়ক ভক্তিমূলক গান। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাওয়ালি-জাতীয় গান থেকেই কালক্রমে খেয়াল নামক উচ্চাঙ্গসংগীতের উৎপত্তি হয়েছে।
‘কওল’ শব্দ থেকে কাওয়ালি শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে বলে মনে করা হয়। আবার অনেকের মতে, দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী কাওয়াল নামক যাযাবর সম্প্রদায় কর্তৃক গীতসাধারণ ভক্তিমূলক গানকে কাওয়ালি বলে চিহ্নিত করা হয়।
প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ আমীর খসরু ‘কাওয়ালি’ ধারার সংগীতের প্রবর্তক বলে স্বীকৃত। তিনিই কাওয়ালি গানের সংস্কার করেন এবং এটিকে একটি প্রথাবদ্ধ রূপদান করেন। বাংলাদেশে কবি কাজী নজরুল ইসলামই এই সংগীতের ধারাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
বাধা দেওয়ার কারণ যদি অপসংস্কৃতি বা উর্দু ভাষা হয়ে থাকে, তাহলে এখন বলতেই হবে কওমি মাদ্রাসায় সকল পাঠ্যবই উর্দু ভাষায়। সেখানে উর্দু পড়ানো কি বন্ধ করেছেন? দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা কখনো এর জন্য প্রতিবাদ করেছেন? করেননি। সরকার প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা কওমি মাদ্রাসার উর্দু শিক্ষায় বরাদ্দ করে। চেতনাধারীদের কাছে জানতে চাই, কেন করেন? আপনার সরকার অনেক আগেই হেফাজতের তেঁতুল পানি খেয়ে বসে আছে। তাই কোনো সময় আপনারা এই বরাদ্দ নিয়ে প্রতিবাদ করেননি।
আরো আছে, বর্তমানে দেশের কোথাও শুনতে পাই না সরকারি খরচে কোনো পাঠাগার তৈরি হতে, কিন্তু ঠিকই জানতে পারি, সরকারি অনুদানে নতুন আধুনিক ৫০০টি মসজিদ তৈরির ঘোষণা আসতে। মসজিদের বিপক্ষে আমি নই, শুধু তুলনা করার জন্য বলেছি। পাড়ায় পাড়ায় এত মসজিদ থাকার পরও সরকার কেন নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করে? এর কারণ আর কিছুই নয়, কারণ একটাইÑধর্ম ব্যবসা। সব সরকারই চায় বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা জিইয়ে রাখতে।
শুধু দুঃখ লাগে, বাংলা মায়ের সোনার ছেলেরা আজও শিক্ষিত হতে পারল না। আজকের ছাত্রসমাজ কেবল ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনীতেই পরিণত হলো। পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে হামলা আর আজকের কাওয়ালি গানের ওপর হামলাকারীরা আমার কাছে একই রকম দেখায়। তোমাদের মূর্খ করে রাখাই রাজনীতির আসল উদ্দেশ্য।
গুন্ডামি করে কোনো অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেওয়া ঠিক নয়। আমিও টিএসসির কাওয়ালি আসর পণ্ড করা নিয়ে প্রতিবাদী স্বরে লিখেছি। গুন্ডামির প্রতিবাদ সব সময় করব। একদিন আগের পণ্ড হওয়া অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে আবারো সেখানে কাওয়ালির অনুষ্ঠান হয়েছে। তার ভিডিও ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে, এখনো কিছু কথা বলার আছে। একদম সাদা চোখে সরলভাবে এটা শুধু গানের অনুষ্ঠান নয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশে কাওয়ালি গানের আসর মসজিদ, দরগা, মাজার, কারো জেয়াফত, ওরস, মিলাদুন্নবী বা আরবি মাসের বিশেষ দিবসকে উদ্দেশ্য করে আয়োজন হতে দেখেছি। কিছু ঘরানার পয়সাঅলাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বা মেহমান এলে কিছু কিছু জায়গায় ঈদ উপলক্ষেও কাওয়ালি আসর হয়।
কিছু সুফিসাধক তাদের বাসাবাড়িতেও এমন গানের আয়োজন করেন। তার মধ্যে আমি দেখেছি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পিএইচপি গ্রুপের মিজানুর রহমান সাহেবের বাসায়। কথা প্রসঙ্গে বলা, বেশি দিন নয়, আজ থেকে ১০-১২ বছর ধরে যিনি নিজেকে সুফি মিজান বলে প্রচার করে আসছেন। ব্যাংকের কাজের সুবাদে ওনাদের বাসায় গিয়েছি। সেখানে কাওয়ালি গানের আসর হতে দেখেছি। তারপর চট্টগ্রামে বারো আউলিয়া পরিবারের সদস্যদের বাসায় কাওয়ালি হতে দেখেছি।
আগে, মানে আমার সময়ে বা এই সেদিনও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানে কাওয়ালি বা গজল হতে শুনিনি। কারণ এসব গানের শ্রোতাও সে রকম হতে হয়। এসব সুফিসাধকদের গান। বেশির ভাগ বয়সী মুরব্বি টাইপের লোকজনই এসব গান শুনতে পছন্দ করেন। সাধারণ পাবলিকের কাছে এর ভাষাও কিছুটা দুর্বোধ্য। মুরব্বিদের দেখেছি, অজু করে তসবি জপতে জপতে এমন অনুষ্ঠানে যেতে।
কথা হলো স্কুল-কলেজের মাঠে, হলের অনুষ্ঠানে, নবীনবরণে কিংবা দেশের অন্যান্য দিবসে দেশের ব্যান্ড দলের শিল্পীদের গান-বাজনা শুনে ছেলেমেয়েদের হইহুল্লোড় করে নাচতে দেখেছি। ভাবনায় আসে না, এসব পোলাপান কবে থেকে এমন কাওয়ালির ভক্ত হয়ে গেল?
টিএসসি এলাকায় এমন হুট করে কাওয়ালিরই-বা আসর বসছে কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কি তাহলে এই কয় বছরে আধ্যাত্মিক ঘরানার হয়ে গেছে? কাওয়ালি তো জাগতিক প্রেমের চাইতে নবী-রাসুলের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার কথা বলে। টিএসসিতে কি তাহলে সুফিসাধকদের চর্চা হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কি এখন তাহলে মাদ্রাসার মতো পড়াশোনার পাশাপাশি আল্লাহ-রাসুলের জীবনকথার সাধনা চলে? পোলাপান কি তাহলে অজু করে পয়পরিষ্কার হয়ে টিএসসিতে চলাফেরা শুরু করেছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলাপান সব তাহলে সুফি ঘরানার হয়ে গেছে। কাওয়ালি গানের আসর ঠিক সাধারণ কোনো গানের আসর নয় যে অলিতে-গলিতে বাজতে শোনা যায়। ফোক ফেস্ট হলে ভিন্ন কথা। যত কথাই বলি না কেন, টিএসসিতে কাওয়ালি গানের আসরÑবিষয়টা এতটা সোজা-সরল কিছু নাও হতে পারে। এখানে অন্য অঙ্ক থাকতে পারে বলে আমার ধারণা।
আমি বাঙালি। সৌদি রাজপরিবার কিংবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আমি ভক্ত নই। তবে বাংলার পাশাপাশি আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি ভাষায় রচিত মহান সব ভক্তিসংগীতের আমি অনুগামী। আমি ওহাবি নই। মারেফত অর্জন করা আমার ব্যক্তিগত সাধনা। দোতরা বাজিয়ে নিরাকার খোদার শানে ভক্তিগীত গেয়ে আমি ক্বলবে শান্তি পাই। মহামতি লালনের বাণীতে আমার মুর্শিদ ব্যাখ্যাত হন। আম্বিয়া-আউলিয়ার শানে পেশকৃত কাওয়ালি সংগীতে আমার ভক্তিভাব জাগ্রত হয়।
সংগীত আমার ভক্তিচর্চার অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাওয়ালি সংগীতের মাহফিলে সন্ত্রাসী হামলা আমার ভাবচর্চার স্বাধীনতাকে বিপন্ন করেছে। আমি বিপন্নবোধ করছি, সংখ্যালঘুরা যেমন বোধ করে আসছে এই উপমহাদেশে ১০০ বছর ধরে। স্পষ্টতই আমি সংখ্যালঘুতে পর্যবসিত হয়ে গেছি, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই আজ সংখ্যালঘু। বাংলা ভাওয়াইয়া ও বাউল এবং উর্দু কাওয়ালি সংগীতচর্চায় আইনি কিংবা বেআইনি হামলা করে বাঙালিত্বের সম্মান, মুর্শিদের সম্মান ইত্যাদি বৃদ্ধি করা হচ্ছে বলে যে দাবি করা হয়, তা আমি অনুভব করি না। তা ভুল।
এই দেশের বটের মূল ও নদীর কূল হতে হানাদার নিপাত যাক। সহজ-সরল মানুষের স্বাধীনতা মুক্তি পাক। জেগে উঠুক জনতা, স্লোগান উঠুক তারুণ্যের। টিএসসির ভাস্কর্যের চেতনায় আবার নতুন সুর বাঁধুক। কবিতার আবৃত্তি রুষ্ট করুক সকল অন্যায়। শুধু অধিকার আদায়ের গণদাবি চাই। শাহবাগ থেকে পল্টন কিংবা টিএসসি থেকে শহীদ মিনারÑরাজপথ কাঁপুক সত্য স্লোগানে। নষ্টদের ভিত নড়ুক নতুন দিনের স্বপ্নবানে।