বেলাল বেগ
‘দশজন দিগম্বর একজন সাধক’ বইটির শিরোনামই এলান করে দিচ্ছে এটি সাধারণ বই নয় এবং এর লেখকও আগে জানান দিয়ে বাংলাসাহিত্যের সমুদ্র সন্তরণে নেমেছেন। শিরোনামটি পাঠককে তাৎক্ষণিকভাবে আকর্ষণ করে। এটি কি ঢাকার মীরপুরের শাহ আলীর দরগাহের দিগম্বর মজনু ফকিরদের গল্প না স্রেফ একটি ন্যুডিস্ট সোসাইটির ক্রিয়াকলাপের বিশদ বিবরণ। কিন্তু ২০১৭ সনে সময় প্রকাশনীর প্রকাশিত বইটির ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় সংস্করণের আত্মপ্রকাশ সাক্ষ্য দেয়, বইটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। পাবারই কথা; শাহাব আহমেদ আমাদের সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন স্বাদ বয়ে এনেছেন আমাদের ভূমন্ডলে তাঁর অবাধ বিস্তর বিচরণের ফলে। ছায়ায় ঢাকা মায়া-মমতা দারিদ্র্যমাখা সবুজ বাংলাদেশ এবং ক্যমিউনিস্ট রাশিয়ার মানুষদের ভিতরে থেকেই মানুষ দেখেছেন শাহাব আহমেদ ১৮ বছরের বাঙালি যুবকের মতই কবিতার পাখায় ভর দিয়ে সাহিত্যে জীবনে জীবন যোগ করার মহান কাজে ঢুকে গেছেন। আসলে অপূর্ব সুন্দর ধরার বিচিত্র মানবজীবনই তাকে সাহিত্যে মোহাবিষ্ট করেছে।
কলেজে পড়া অবস্থায় কবিতা লিখতেন শাহাব। ছাত্রবৃত্তি পেয়ে সোভিয়েট ইউনিয়নে উচ্চশিক্ষায় চলে গেলে, তাঁর বড় ভাই হারিয়ে যাবার ভয়ে তাঁর তখনকার কবিতা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লেখা তাঁর চিঠিগুলোকে বই আকারে প্রকাশ করে দিলে শাহাবের নামে আগেই দুটি বই বেরিয়ে গিয়েছিল। তাঁর কবিতা ও ছড়ার বইটির নাম, ‘অদৃশ্য মুষিক এক’ আর ভ্রমণ কাহিনীটির নাম, লেনিনগ্রাডের চিঠি’। সুখপাঠ্য ছবির মত শব্দচিত্রিত বইগুলো সম্বন্ধে শাহাব বলেন, ওগুলো ছিল এক চোখ কানা হয়ে জন্ম নেয়া বেড়ালের বাচ্চাদের মত। নিজের সৃষ্টি সম্বন্ধে শাহাব যাই বলেন না কেন, আমতা দেখলাম বাংলা সাহিত্যে শাহাব কথা বলার দারুণ একটা নিজস্ব চমক এনেছেন।
শাহাব আহমেদের বেড়ালছানাগুলো সোভিয়েত জীবনের বিশাল ক্যানভাসে পড়ে একটা অদ্ভূত প্রাপ্তবয়ষ্ক বেড়ালে পরিণত হয় যা দেখতে যেমন সুন্দর কোলে নিলে হয় তেমনই কোমল সুখানুভূতি। বাংলাদেশের সামাজিক পটভূমিতে দিগম্বর ও সাধু সাজা সহজ ছিল না কিন্তু সভিয়েত ইউনিয়নের সম্পূর্ণ বাধাবন্ধনহীন জীবনে হঠাৎ লেখক আবিস্কার করলেন নিজস্ব পরিমন্ডলে যে কেউ আপনারে ছাড়া অন্যকে কুর্নিশ না করেই বাঁচা যায়। পুরুষ হস্টেলে বান্ধবী এসে খুব সহজেই বন্ধুর বিছানায় শুয়ে পড়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে নাক ডেকে।
‘দশজন দিগম্বর ও একজন সাধক’ বইটি কোন গোত্রের, এমন ঋজু সাহিত্যবিচার শাহাবের ক্ষেত্রে সহজ নয়। কারণ এটি ভ্রমণ কাহিনী, ইতিহাস, দৈনন্দিন জীবন কথা, স্রেফ কল্পকথার সাহিত্য ইত্যাদি নানা অভিধায় একসঙ্গে ভূষিত হতে পারে। শাহাব সজ্ঞান সাহিত্য করেন নি, তিনি লিখেছেন তাঁর মত করে। কেক’র ড্রেসিং দেয়ার বিচিত্র রঙের ক্রীম যেমন বর্ণাঢ্য কেকের জন্ম দেয়, শাহাবের জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা, পুরাতত্ত্ব, বিশ্বইতিহাস, বিশ্বসাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি জ্ঞানরাজ্যে অবাধ বিচরণ এবং বিশেষ করে ক্যমিউনিস্ট মুক্তচৈতন্যই শাহাব আহমেদকে বাঙালি বিদগ্ধ পাঠকদের কাছে লোভনীয় করে দিয়েছে। এই সাক্ষ্য আমরা পাই ফেসবুকে শাহাব আহমেদের চলমা লেখাগুলিতে পাঠকদের মন্তব্য থেকে। বলা বাহুল্য শাহাব আহমেদের প্রতিটি লেখাই অসামান্য তথ্যবহুল, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাময় যেখানে সব ছাড়িয়ে বড় হয়ে যায় তাঁর স্বদেশ, স্বজাতি, তার হাজার বছরের মানবিক ইতিহাস, তার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং তার অবিরাম জয়পরাজয় যাত্রা। আমরা ভাগ্যবান, আমাদের কালে বনফুলের মত পেশায় ডাক্তার শাহাব আহমেদ সহ আরও কয়েকজন ডাক্তার লেখক পেয়েছি।
শেষ করার আগে শাহাব আহমেদের ভাষাব্যবহারের দিকটা দেখা যাক। অর্জুনের তীরের মত শাহাবের লক্ষ্য থাকে লেখাটাকে পাঠকের কাছে স্ফটিক স্বচ্ছ করে দেয়া। এজন্যে তিনি এন্তার উপমার আশ্রয় নেন তিনি। বিশ্বের সব পৌরাণিক দেবতারা যেন মুখিয়ে থাকে তাঁর লেখায় ঢোকার জন্যে। এতে সাধারণ পাঠকের একটু অসুবিধা হলে তারা নিজেদের কল্পনার দৌড়ে ধরে ফেলেন গল্পের অগ্রযাত্রাটি। বাংলায় শাহাবের শব্দসম্ভার ঈর্ষনীয়। তারপরেও প্রয়োজনে শাহাব ইংরেজি বা রাশিয়ান ভাষার দিকে হাত বাড়াতে কসুর করেন না। তাঁর কাছে লেখার সাবলীলতা ও গতিশীলতাই প্রধান। আমার দৃঢ় বিশ্বাস পাঠকপ্রিয়তার মুকুট তিনি ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। আমরা অনেকদিন শাহাবের সঙ্গে থাকব বলে আশা করি। শাহাবের লেখায় এখন পর্যন্ত একজন সাংবাদিক লেখককেই দেখা যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘একজন আবুল কাসেমের জীবন’ লেখাটিতে আমরা সাহিত্যিক শাহাবের পরিচয়ও পেয়ে গেছি। হয় ত বা এ গাঙেই ভাসাবেন তিনি তাঁর জীবন তরী। কে জানে!
নিউইয়র্ক।