হাসান রাজীব
সারা দেশে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গত ২ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে সারা দেশে একসাথে শুরু হয় এ পরীক্ষা। এবারের পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য গতানুগতিকের বাইরে একটু ভিন্ন ধাঁচের ও ব্যতিক্রম।
এবার এসএসসির মতো এইচএসসিতেও পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের অবশ্যই পরীক্ষা কক্ষে আসন গ্রহণের নির্দেশনা ছিল। যদিও প্রথম দিনই অনেক শিক্ষার্থী দেরি করে কেন্দ্রে আসে। কারণ হিসেবে তাদের বেশির ভাগই যানজটকে দায়ী করেছে।
এবারই শিক্ষার্থীদের নাম খাতায় এন্ট্রি করে কারণ উল্লেখ করে তারপর কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে প্রবেশের কথা থাকলেও অনেক শিক্ষার্থীকে ৯টা ৪০ মিনিটের পরেও প্রবেশ করতে দেখা যায়।
এতো গেল শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেয়ার আগে এক ধরনের প্রস্তুতি পরীক্ষা। ঠিক একইভাবে পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্বরত শিক্ষকদের দায়িত্ববোধের কারণে অন্যবারের চেয়ে এবার তাদের কর্মযজ্ঞ বেড়ে গেছে। প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা ও সাবধানতার ওপরে বাড়তি তাগিদ রয়েছে মন্ত্রণালয় থেকেও। এ দায়িত্ব থেকে কোনো ধরনের অসাবধানতা ও ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করা হবে না বলেও নির্দেশনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বলা চলে ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও যেন এবার পরীক্ষার মুখোমুখি।
পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে দেশের সব কোচিং সেন্টারগুলোও। এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, পরীক্ষার সময় এইচএসসি সংশ্লিষ্ট কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর এই নির্দেশনা মানতে সংশ্লিষ্ট কোচিং সেন্টারগুলোও এক নতুন পরীক্ষার দ্বারপ্রান্তে।
এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরতো সন্তানের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এত সব পরীক্ষার মধ্যেও এবার সবচেয়ে বড় যে পরীক্ষার্থী দেশ ও জাতির কাছে পরীক্ষা দিচ্ছেন তিনি আর কেউ নন। তিনি স্বয়ং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও এ বিষয়ে বিস্তর অভিযোগে তিনি আজ জাতির কাছে এক অঘোষিত পরীক্ষার মুখোমুখি।
বর্তমান সময় ডিজিটালাইজেশনের কারণে কোনো কিছুতেই লুকোচুরি সম্ভব নয়। তেমনি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় শতভাগ পাস নিশ্চিত ও চাকরি প্রাপ্তির দৌড়ের কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়োমিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের পাবলিক পরীক্ষায় এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন অতি সাধারণ বিষয়। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও অনেকটা অসহায় বোধ করছে।
পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস গোটা জাতির জন্যই উদ্বেগজনক। দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে এসএসসি পরীক্ষা নেয়ার যে সাফল্য, তা এই কেলেঙ্কারিতে অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে।
অতি সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ের সময় একাধিক অভিভাবক প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। মন্ত্রীও অভিভাবকদের আস্বস্ত করেছেন এ ব্যাপারে তিনি সম্ভবপর সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
গত ২ এপ্রিল সকালে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনের পর শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রশ্নফাঁস করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মানুষের সাধ্যের মধ্যে যা যা করা সম্ভব প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে তাই করা হচ্ছে। তার পরও যদি এমন ন্যক্কারজনক কাজের সঙ্গে কেউ জড়িয়ে পড়ে তবে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্ত্রী বলেন, প্রতিটি পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য আলাদাভাবে দুটি প্যাকেটে সিলগালা ও সিকিউরিটি প্যাকে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে কেন্দ্রীয়ভাবে সারা দেশে প্রশ্ন সেট নির্ধারণ হয়েছে। সে প্রশ্ন দিয়েই আজকের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রশ্নফাঁস হওয়ার সব সম্ভাবনায় কড়া নজরদারি বসানো হয়েছে। তাই প্রশ্নফাঁসের কোনো সুযোগ নেই।
এখনো কিছু কোচিং সেন্টার খোলা রয়েছে বলে মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, পরীক্ষার সময় এইচএসসি সংশ্লিষ্ট কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
প্রশ্নফাঁসের আর কোনো সুযোগ নেইÑ শিক্ষামন্ত্রীর এ ধরনের আশ্বাসে দেশবাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও তা মূলত কতটা কার্যকর ও বলবৎ থাকবে তা এখন কেবল সময়ই বলে দিতে পারে। তাই সচেতন মহল মনে করছে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়েরও দায়িত্ববোধের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে।
এ দিকে, প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ গত ২ এপ্রিল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে র্যাবের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা কার্যক্রম চলছে। প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যরাও এক ধরনের সন্ত্রাসী। এই প্রশ্ন সন্ত্রাসীদের অবশ্যই আমরা জঙ্গিদের মতো করেই নিশ্চিহ্ন করবো।
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, গত বছর এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের কাছে প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারের কথা বিবেচনা করে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ছাড় দেয়া হয়েছে। তবে চলতি বছর আর সে সুযোগ দেয়া হবে না। র্যাব কর্মকর্তারা নিজ নিজ এলাকার পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো মনিটরিং করছে। কোনো শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের কাছে সত্য বা মিথ্যা যে ধরনের প্রশ্নই হোক না কেন, পাওয়া গেলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার সদস্যরাও প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে আর এক নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে সে কথা বলাই যায়।
প্রসঙ্গত, গত ২ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে সারা দেশে একাযোগে শুরু হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ বছর ১০ লাখ ৯২ হাজার ৬০৭ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে এবার পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে কেন্দ্রীয়ভাবে লটারির মাধ্যমে প্রশ্ন সেট নির্ধারণ করে সব বোর্ডে অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিটি কেন্দ্রে একাধিক প্রশ্নের সেটও পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এবার সারা দেশে ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে। গত বছরের চেয়ে এবার এক লাখ ২৭ হাজার ৭৭১ পরীক্ষার্থী বেড়েছে। বৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এবার ছেলেদের চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। ছেলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছয় লাখ ৯২ হাজার ৭৩০ এবং মেয়ে ছয় লাখ ১৮ হাজার ৭২৮ জন।