সামছুদ্দীন আজাদ :
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের পুলিশপ্রধান (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ জাতিসংঘের আয়োজনে পুলিশ সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করলেন। এই সম্মেলনে যোগ দিতে ছয়জন সরকারি প্রতিনিধি যথারীতি ভিসা পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। জাতিসংঘের আয়োজনে পুলিশ সম্মেলনের তারিখ ছিল ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর। মিটিং শেষ করে ৩ সেপ্টেম্বর তারা নিউইয়র্ক ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে যান।
আইজিপি বেনজীরকে যুক্তরাষ্ট্রে শুভেচ্ছা স্বাগত। আপনি বীরের বেশে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন আবার দুই দিনের পুলিশ সম্মেলন সফলভাবে শেষ করে স্বদেশে ফিরে গেলেন বীরের বেশেই। আপনার আগমনে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ছিলেন ভীষণ উচ্ছ্বসিত ও আনন্দিত। একইভাবে প্রবাসের দেশপ্রেমিক জনগণের বৃহত্তর একটা অংশও আপনার আগমনে অত্যন্ত খুশি হয়েছে। খুশি হয়েছে আপনার এলাকা গোপালগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ। নানা কারণে জনাব বেনজীরের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে আসা নিয়ে এখানকার প্রবাসী বাংলাদেশি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা কৌতূহল ছিল, তিনি ভিসা পাবেন কি না? পুলিশ সম্মেলনে যোগ দিতে আসতে পারবেন কি না? অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হলো।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ বাংলাদেশের সাত সাবেক ও বর্তমান র্যাব কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়, যেহেতু তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তাই তাদের সাতজনের কেউ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না এবং যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কোনো সম্পদ থাকলে সেটির ওপরও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র সরকার আইজিপিকে ভিসা দিয়েছে, ভিসা দিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে। এ ছাড়া এই ডেলিগেটের আরও যারা ভিসা পেয়েছেন, তারা হলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোস্তফা জামান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব) মু. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ উপ-মহাপরিদর্শক নাসিয়ান ওয়াজেদ ও সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মাসুদ আলম।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গাম্বিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেইয়াকা সনকো ও জাতিসংঘের সন্ত্রাস দমন বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ভøাদিমির ভরনকভের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে স্থানীয় সময় ৩১ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সন্ত্রাস দমন ও মোকাবিলায় জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করে চলেছে বাংলাদেশ সরকার। তিনি সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশের অবদানের কথা তুলে ধরেন। গাম্বিয়ার পুলিশ বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ সহায়তা সম্প্রসারণ বাংলাদেশের পুলিশের সক্ষমতা সম্পর্কে গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেন আইজিপি। Bangladesh Institute of Peace Support Operation & Training-এর প্রশিক্ষণ সুবিধা সম্পর্কে গাম্বিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। জাতিসংঘের সমস্ত কার্যক্রম শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে গত ৩১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সভা পরিচালনা করেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ আজাদ। পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র নাগরিক কমিটির ব্যানারে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদকে। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সভাটি সঞ্চালনা করেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য হিন্দাল কাদির বাপ্পা। প্রধান অতিথি হিসেবে দীর্ঘ এক ঘণ্টারও বেশি সময় জনাব বেনজীর আহমেদ তার জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন। দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো অধীর আগ্রহ নিয়ে তার বক্তব্য শোনেন। তিনি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেন। জাতির জনকের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দেওয়া ৩০ লাখ শহীদের জীবনদান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম ত্যাগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, চার হাজার বছরের বাঙালির সভ্যতা ও শাসনামলে আমরা শাসক হতে পারিনি, আমরা হয়েছি শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত। বঙ্গবন্ধুই আমাদের মুক্ত করেছেন ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণ থেকে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করছেন। ২০৪১ সালে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায় উঠে আসবে। আইজিপি আমাদের Per Capita Income নিয়ে কথা বলেছেন, তিনি বিশ্বব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেছেন। স্বাধীনতার পরপর আমাদের রিজার্ভ প্রায় শূন্য ছিল। সেই জায়গা থেকে আজ ৪৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, সে কথাও তিনি বলেছেন। আলোচনার একপর্যায়ে তার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেন। তিনি বলেন, আমি এই আমেরিকায় থেকেছি, লেখাপড়া করেছি, চাকরিও করেছি। আমেরিকার কাছে যে অভিযোগ করা হলো, সেখানে বলা হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে নাকি ৬০০ লোককে গুম করেছে র্যাব। সে তালিকা বিএনপি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে দিয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তো আমি র্যাবে ছিলাম না। ২০১৫ সালে আমি র্যাবে এসেছি, তাহলে কেন আমাকে অভিযুক্ত করা হলো? আজকের যে নিষেধাজ্ঞা, সেটি মিথ্যাচার এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিএনপিসহ যারা লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে, তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এটি করেছে। গত তিন বছর ধরে লবিস্ট ফার্ম এই কাজটি করছে এবং চারটি লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে ১০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে বিএনপি। বার্ষিক ২৫ মিলিয়ন ডলার চুক্তিতে চার বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার শর্তে বিএনপি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তবে তিনি এই নিষেধাজ্ঞার জন্য আমেরিকাকে দায়ী করেননি, আমেরিকার কোনো সমালোচনাও করেননি। কাজটি তো করেছে আমাদের দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত জোট এবং মানবাধিকার সংগঠন ও কিছু এনজিও। আমেরিকা ও বাংলাদেশের সম্পর্ক চমৎকার। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের রয়েছে শেয়ারিং, আছে বাণিজ্য, কূটনীতিক সম্পর্ক। উন্নয়নের অংশীদারও আমেরিকা।
হেফাজতের আন্দোলন দমনের ইতিহাসও তুলে ধরেন জনাব ড. বেনজীর। হেফাজতকে দমনের পর বলা হলো কয়েক হাজার হেফাজত কর্মীকে নাকি হত্যা করা হয়েছে। অধিকার নামক একটি এনজিওসহ আরো কয়েকটি এনজিও এমন অপপ্রচার চালিয়েছিল। পরে যখন আমরা বললাম, মৃতদের নামের তালিকা দিন, তারা কোন মাদ্রাসার ছাত্র সেই মাদ্রাসার নাম দিন, তাদের মা-বাবার ঠিকানা দিন, বলা হলো মৃতদের কবরের জায়গা কোথায় হয়েছে, সেটাও দিন। কিন্তু কোনো তথ্য দিতে পারেনি এসব এনজিও। এই এনজিওগুলোকে বাংলাদেশে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ২০০১ সালে জোট সরকারের আমলে, যখন জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। দেশ-বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারের জন্য ২২ জন তথ্য সন্ত্রাসী রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওদের দেওয়া বিভ্রান্তিমূলক তথ্য আইজিপি বিশ্বাস না করতে বলেছেন এবং ওদের এসব অপপ্রচার না দেখারও আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে কিন্তু তা হয়নি; হয়েছে মিথ্যাচার, গুজব, অপপ্রচার, আজগুবি আর ভুয়া তথ্যের প্রচার। এসব নোংরা জিনিস ফেসবুকে দেখামাত্র ফ্লাশ করে দেওয়ার কথা বলেছেন। দেশ সম্পর্কে, উন্নয়ন সম্পর্কে, বিরোধী রাজনৈতিক অপশক্তির সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে, পাক-ভারত রাজনীতি নিয়ে, মোগল শাসনামল, ব্রিটিশ শাসনামল, এই বাংলার হিন্দু শাসক পাল বংশের, সেন বংশের শাসকদের ইতিহাস তুলে ধরেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে এসে পর্যায়ক্রমে সমৃদ্ধশালী এই বাংলার সব ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে এই বাংলাকে শূন্য করে দিয়ে গেছে। তিনি তার এথেন্স যাওয়ার কাহিনি, পর্তুগাল যাওয়ার কাহিনি শোনান, সেখানে বাঙালিরা কীভাবে সংগ্রাম করে টিকে আছে, সেসব রোমাঞ্চকর কাহিনিও উপস্থাপন করেন। সবশেষে বিভিন্ন সংগঠন থেকে আইজিপিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।
মজার ব্যাপার হলো, যখন আইজিপির যুক্তরাষ্ট্রে আসার কথা প্রচার হলো, বিদেশে থাকা জামায়াত-বিএনপির লোকেরা লাফালাফি শুরু করে দিল। বলা শুরু করল, আইজিপি ভিসা পাবেন না, পুলিশ সম্মেলনে আসতে পারবেন না। এরপর যখন তিনি ভিসা পেলেন, তখন বলা হলো দুই দিনের ভিসা দেওয়া হয়েছে, মাত্র দুই দিন থেকে দেশে চলে যেতে হবে। হোটেল থেকে বের হয়ে তিনি কোথাও যেতে পারবেন না। বের হলেই গ্রেফতার করবে আমেরিকান পুলিশ। এই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে ভস্ম ছিটিয়ে আইজিপি জাতিসংঘের পুলিশ সম্মেলন শেষে প্রকাশ্যে বেরিয়ে এলেন গণসমাবেশে। শত শত লোক ও মিডিয়ার উপস্থিতিতে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন অত্যন্ত খোলামেলাভাবে। তারা দেশে যেমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে, বিদেশে বসেও দেশবিরোধী অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। তারা কোনো কিছু করতে না পেরে জাতিসংঘের সামনে দাঁড়িয়ে সরকারবিরোধী, দেশবিরোধী অশ্রাব্য গালিগালাজ করেছে। আসলে তারা রাজনীতিই বোঝে না।
লেখক : সহসভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ