বিশেষ প্রতিনিধি : যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতিদিন একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এমনকি স্কুল, শপিং মল, রেস্তোরাঁয় হত্যাকাণ্ড ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজেদের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়া -এগুলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোজাসাপ্টা বক্তব্য। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব সাহসী-অবিশ্বাস্য মন্তব্য করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না-এমন একটি মন্তব্যও করেন শেখ হাসিনা। কেন দেশটি আপনাকে আর ক্ষমতায় চায় না?-বিবিসির এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মারাত্মক অভিযোগ করে বসেছেন শেখ হাসিনা। জবাবে বলেন, যারা আমার পরিবারকে হত্যা করেছে, এমনকি ১০ বছরের ভাইকে হত্যা করেছে, সেই ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না এই পরিবারের কেউ ক্ষমতায় আসুক। প্রধানমন্ত্রী বাতকেবাত কথাগুলো বলে
ফেলেছেন, এ ধরনের কথার সুফল-কুফল তিনি জানেন না-তা ভাবার কোনো কারণ নেই। একইভাবে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের বিশেষ সুবিধা তুলে নিলে কী হতে পারে, তাও তিনি বোঝেন না ভাবা যায় না। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঢেউ। সরকারের সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের গন্ডগোলে বগল বাজাচ্ছে বিএনপি। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সফরে প্রধানমন্ত্রী প্রটোকল না পাওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে এখন ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের প্রটোকল তুলে নিচ্ছেন-এমন একটি প্রচারণা চলছে বিএনপি থেকে। এ সরকার ক্ষমতায় আছে আর মাত্র দু-তিন মাস-এমন প্রচারণাও আছে তাদের। কোত্থেকে, কোন শক্তিতে তাদের এমন বার্তা? জাতীয় নির্বাচন কি দু-তিন মাস পরই যে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতাহীন হয়ে যাবে আওয়ামী লীগ? অথবা বিএনপির আন্দোলন এত তেজোদীপ্ত, যার তাপে-চাপে সরকার ক্ষমতা ছেড়ে পালাবে?
এসব জিজ্ঞাসা এড়িয়ে দলটির কয়েক নেতার চলনে-বলনে বিজয়ী ভাব। বিএনপির মহাসচিব কোনো দিন-তারিখ উল্লেখ না করে বলেছেন, হাতে সময় খুব কম। এ সময়ের মধ্যে সরকার দ্রুত সেফ এক্সিট না নিলে পরে পালানোর পথও পাবে না। অন্যদিকে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের মনোভাব অনেকটা একরোখা। কারও হাতে ক্ষমতা দিয়ে সরে পড়া বা সংবিধানের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার মতো কাজ না করার সিদ্ধান্তে অটল প্রধানমন্ত্রী। পরিষ্কারভাবে এ বার্তা জানিয়েছেন দেশ-বিদেশ সব জায়গায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানের মতো সুপার পাওয়ার দেশ সফরের সময় তা বলে এসেছেন। দেশে ফিরে প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনে তার অবস্থান আরও পরিষ্কার করেছেন। মোটকথা, বলার আর কিছু বাকি রাখেননি।
সরকারের সক্ষমতা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি-কূটনীতির প্রোফাইল বিএনপি জানে। বিদেশিদেরও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুর বেলায় শেখ হাসিনা ঝুঁকি নিয়ে সফল হয়েছিলেন, এবার তিনি আরও বড় ঝুঁকি নিয়ে সফল হতে চান। বাকিটা ভবিষ্যৎ। ‘কথা নাই বার্তা নাই, স্যাংশনের ভয় দেখাবে, আর আমরা ভয়ে মুখ বুজে থাকব কেন? -যুক্তরাষ্ট্রকে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। স্যাংশন দেওয়া দেশ থেকে আর কিছু কেনাকাটা করা হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনের পরদিন বিস্ফোরণ বিবিসিতে। সেখানে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় চায় না। এর কদিন আগে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইলে কাউকে ক্ষমতায় বসাতে পারে, নামাতেও পারে। এ রকম এক কঠিন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টক্করের সাহস দেখানোর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্ব মানচিত্রে নিজের একটা অবস্থান এরই মধ্যে তৈরি করে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত নিউজ আইটেম হচ্ছেন গত ক’দিন ধরে।
অনিবার্য বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকের সংজ্ঞা-ব্যাখ্যা একেবারেই তাদের নিজেদের মতো। তারা কিছু তবে, যদি, কিন্তু দিয়ে বাক্য তৈরি করে। তা বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একটু বেশি। যেমন পাকিস্তানে যা কিছু হচ্ছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবে সহিংসতা এড়িয়ে প্রতিবাদ হওয়া উচিত। নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ‘তবে’ যুক্ত বাক্যের প্রতিটি শব্দ নানান অর্থে ভরা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক শব্দে অনেক অর্থ। তারা কখন কোনটাকে আসল মনে করে বোঝা কঠিন। কখন কোনটা অভ্যন্তরীণ আর কখন আন্তর্জাতিক বলা শক্ত। বিদেশি কূটনীতিক বা সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব হোস্ট কান্ট্রির ওপরই বর্তায়। সম্প্রতি বেশি বেশি উচ্চারিত জেনেভা কনভেনশনেও তা বলা আছে। এ ছাড়া কূটনীতিকদের কী ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থায় থাকতে হচ্ছে, এটি সংশ্লিষ্ট দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটা ইন্ডিকেটরও। বর্তমান সরকার যে তাদের জন্য তা করেনি বা করছে না, বিষয়টি এমন নয়। বরং বেশি খাতির দেখাতে বাড়তি ব্যবস্থাও করেছিল কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের জন্য, যা ফাউ গেছে বলে মনে করছে সরকার। বিএনপি সরকারের আমলে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলার পর ছয়টি দেশের দূতরা নির্ধারিত নিরাপত্তার বাইরে অতিরিক্ত পুলিশ পেট্রল পেতেন। পরে আরও কেউ কেউ পেতে থাকেন। অন্য অনেক দেশের কূটনীতিককেই তোহফা দেওয়ার মতো সরকার সেই বাড়তি প্রটোকল দিয়েছে। এখন বাড়তিটা প্রত্যাহার করতে গিয়ে নানান কথা সামনে চলে এসেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রকাশভঙ্গি ও কিছু আলগা কথায় গোলমাল পেকেছে।
সরকারের হিতাকাক্সক্ষী কেউ কেউ বলছেন, কূটনীতিকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে এতটা পাবলিসিটিতে যাওয়ার দরকার ছিল না। এর বিপরীতে আরেক গ্রুপ বলছে, পাবলিসিটিতে গিয়ে পপুলিস্ট রাজনীতিতে লাভ হয়েছে। সরকার বিদেশিদের কেয়ার করে না, জনগণই আসল-এমন মেসেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এতে কর্মীরা উজ্জীবিত হবে, যারা গত কিছুদিন সরকার পড়ে যাচ্ছে ভেবে সাইডলাইনে চলে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের মতো দেশে আমজনতার কাছে এই ধরনের স্ট্যান্ড ভালোই ভ্যালু অ্যাড করবে বলে বিশ্বাস এ মহলটির। কোনো হোস্ট কান্ট্রিতে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা কমানোর এমন প্রকাশ্য ঘোষণা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ঘটেনি। যে কটি দেশকে এই বার্তা দেওয়া হলো তারা বাংলাদেশের শত্রুরাষ্ট্রও নয়। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ ছয় দেশের রাষ্ট্রদূতরা আর বাড়তি নিরাপত্তা পাবেন না, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের এমন ঘোষণার পর বিবৃতি দিতে বেশি দেরি করেনি যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। সব কূটনৈতিক মিশন ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে হোস্ট রাষ্ট্র বাধ্য বলে বার্তা দেওয়া ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের যুক্তির ভিত্তি ভিয়েনা কনভেনশন।
কূটনীতিকদের বিষয়ে সরকারের এ সিদ্ধান্ত জানানোর সময় অবশ্য কোনো ক্ষোভের কথা বলা হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থনৈতিক অবস্থার অজুহাত দিয়েছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নানা কৃচ্ছ্রসাধন করতে হচ্ছে বলে যুক্তি দেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে বলে ফেলেছেন, কূটনীতিকদের বাড়তি নিরাপত্তা-সুবিধা দিলে বিদেশিদের কাছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা নিয়ে ভুল বার্তা যায়। ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে সরকারের বিদেশি কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে করণীয় ক্ষমতা খুব সীমিত। কনভেনশনটি কূটনীতিক বান্ধব। কেবল নিরাপত্তা নয়, কূটনীতিকদের জন্য আরও অনেক কিছু করতে হয় হোস্ট কান্ট্রিকে। কোনো দেশে অন্য দেশের মিশন কতটা বড় হবে, তা-ও উল্লেখ রয়েছে ভিয়েনা কনভেনশনে। মিশনের অফিস এলাকায় বিদেশি কূটনীতিক মিশনপ্রধানের অনুমতি ছাড়া গ্রাহক দেশের সরকারে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ভিয়েনা কনভেনশনের ২৯ ধারা অনুযায়ী, বিদেশি কূটনীতিকদের আটক বা গ্রেফতার করা যাবে না। তারা গ্রাহক দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার বাইরে। মারাত্মক কোনো অভিযোগ না থাকলে কূটনীতিক এজেন্টদের ব্যাগও তল্লাশি করা যাবে না। এমনকি তারা কোনো ঘটনায় সাক্ষ্য দিতেও বাধ্য থাকবেন না। কূটনৈতিক মিশনের সব সদস্য ওই দেশের সবখানে অবাধে চলাচল করতে পারবেন। এসব ধারা নিয়ে বাংলাদেশে কখনো গোলমাল পাকেনি। সামনে কোনো গন্ডগোল পাকে কি না, সংশয় ঘুরছে। বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, সেই শঙ্কাটি তত জোরালো হচ্ছে।
শেখ হাসিনার গ্লোবাল গেম
ঘোলা পানিতে বিএনপির মাছ ধরার স্বপ্ন