ড. নুরুন নবী :
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই ছিল তুঙ্গে। এ দুই বৃহৎ শক্তি তাদের ব্লক ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। অন্যদিকে চীন ক্রমে ক্রমে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছিল। প্রতিবেশী সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে প্রতিযোগিতা ছিল। এই বৃহৎ শক্তির ঠান্ডা লড়াই ভারতীয় উপমহাদেশেও বিস্তার লাভ করে।
প্রতিবেশী চীনের প্রভাব মোকাবিলা করতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। উপমহাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের প্রভাব বিস্তার রুখে দেওয়ার জন্য আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বৈরিতা পাকিস্তান জন্মের পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল থেকেই লেগে ছিল। ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিশালী করতে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এদিকে ভারতের সঙ্গে চীনের বৈরিতা ছিল নানা কারণে। এসব দেশের মধ্যে বৈরিতা ও প্রতিযোগিতার রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও ছিল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই এসব নানান জটিল কারণে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিসমূহের মধ্যে পরিষ্কার বিভক্তি দেখা দেয়। বাংলাদেশের পক্ষে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায় আমেরিকা ও চীন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ভিত্তি স্থাপন করেন সুদূরপ্রসারী নীতির ওপরÑসবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়। এই নীতির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু বৈদেশিক নীতিতে অনেক সাফল্য অর্জন করেন। এই সাফল্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠানো, শতাধিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, জাতিসংঘ, ন্যাম, ওআইসি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধু যখন দেশ গঠনের কাজে ব্যস্ত, তখন দুজন মেজর দেশি-বিদেশি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিজ বাসভবনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। তাঁরা দুজন সে সময় জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। শেখ হাসিনার স্বামী বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া জার্মানিতে গবেষণাকাজে নিয়োজিত ছিলেন। শেখ হাসিনা তাঁর এক পুত্র, এক কন্যা এবং ছোট বোন রেহানাসহ স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করায় তাঁরা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনে। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ নীতির পরিবর্তে ক্ষণস্থায়ী এবং অ্যাডহক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে সাফল্য আনতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহৎ শক্তি, যথা আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহ, জাপান, আরব এবং আফ্রিকার দেশসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কোনো দেশের সাথে বৈরিতা নেই।
পররাষ্ট্রনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান সাফল্য হলো বৃহৎ শক্তিসমূহের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। তিনি প্রতিবেশী ভারত, চীন, বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে স্বাধীনভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এসব দেশের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন উন্নয়নের অংশীদারত্ব।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। বাংলাদেশের তিন দিকে রয়েছে ভারতীয় সীমান্ত। ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বিশেষ অবদান দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে প্রধান ফ্যাক্টর। এ ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতের অর্থনৈতিক সাহায্য অনুকূলনীয়। শেখ হাসিনা ভারত-বাংলাদেশের এই জটিল সম্পর্ক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিরোধী দল বিএনপি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতবিরোধী স্লোগান দিয়ে ফায়দা তুলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর দক্ষ রাজনীতির মাধ্যমে বিএনপির ভারতবিরোধী রাজনীতিকে পরাজিত করেই চলেছেন।
শেখ হাসিনা অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা ও বিজ্ঞ বৈদেশিক নীতির সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার আমানত বৃদ্ধি প্রভৃতি অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশকে আজ এশিয়ার অগ্রগামী দেশে পরিণত করেছেন। শেখ হাসিনার রাষ্ট্রপরিচালনার প্রজ্ঞা আজ বিশ্বে সমাদৃত। তাঁকে জানাই জন্মদিনের আন্তরিক শুভেচ্ছা। আপনি দীর্ঘজীবী হোন।
লেখক : সভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদ