শেখ হাসিনা, ইমরান খান এবং বিশ্বসন্ত্রাস

জয়ন্ত ঘোষাল : রাজনৈতিক পরিভাষায় সন্ত্রাসবাদ একটা খুব চেনা শব্দ। সন্ত্রাস কথাটা শুনলেই একধরনের ভয়, বিপদ আর অর্থহীন অনর্থর অনুভূতি ধ্বংসের অনুভূতি হয়। অকারণে সাধারণ নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। চরমপন্থী মত আর বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখে সন্ত্রাসবাদীরা। তার জন্য ওরা জীবন দিতে কিংবা আত্মহত্যা করতেও পিছপা হয় না। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নামক শব্দটিও অধুনা খুব জনপ্রিয় হয়েছে। দেশ-দেশান্তরের সীমা ছাড়িয়ে এ সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে। সন্ত্রাসবাদের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা কী ঠিক জানি না, কিন্তু এটা বুঝতে পারছি সন্ত্রাস যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদ ও জিহাদি মতাদর্শের শিকড় থেকে উৎসারিত হয়, আবার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও আছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যুদ্ধ এবং সংঘাত ও সংঘর্ষের জন্ম দেয়। আবার একজনের কাছে যা সন্ত্রাসবাদ অন্যের কাছে সেটাই হয়ে ওঠে মুক্তির সংগ্রাম।

সার্ক অধিবেশন থেকে রাষ্ট্রসংঘের অধিবেশন সর্বত্র সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে বারবার। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এই তিনটি দেশই জিহাদি সন্ত্রাসের হাতে আক্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা এবং ইমরান খান দুজনেই ভারতের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আজ যখন ভারত এবং পাকিস্তান সীমান্ত সন্ত্রাসে উত্তাল তখন মনে হচ্ছে ইমরান খান এবং শেখ হাসিনা এ যেন a tale of two prime ministers দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কতখানি ফারাক এক দিকে মুসলমান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সন্ত্রাসকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছেন। মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই ভয়ংকর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। তখন আমি আনন্দবাজার পত্রিকার দিল্লি সম্পাদক। মনে আছে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ অনেক রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই গণতন্ত্র ধ্বংস করতে কায়েমি স্বার্থ যে তলে তলে সক্রিয় সেটা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।

পরবর্তী সময় দেখলাম শেখ হাসিনা শক্ত হাতেই এই মৌলবাদী শক্তির মোকাবেলা করলেন। বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও ঢাকায় কী হয়েছিল তাও তো কোনো গোপন ঘটনা নয়। তবু হাসিনা বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর স্বায়ত্তশাসনের পরিসর দিয়ে, প্রতিরক্ষা বাজেটে অগ্রাধিকার স্বীকার করেও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ শাসনকে ধরে রেখেছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উলফা জঙ্গিরা বাংলাদেশের জমি ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করেছিল, হাসিনা সরকার তাদের নির্মূল করার চেষ্টা চালিয়েছে। বহু জঙ্গিকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। অনুপ চেটিয়া বা পরেশ বড়ুয়ার মতো জঙ্গি নেতাদের সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করেছে। অরবিন্দ রাজখোয়া ফিরে এসেছেন আসাম। আর ভুটান থেকে উলফা জঙ্গিরা তাড়া খেয়ে মিয়ানমার গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু চট্টগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
অন্য দিকে ইমরান খান কী করছেন, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সদ্য নির্বাচনে জিতেছেন। কিন্তু পুলওয়ামার আক্রমণের পর প্রমাণ হয়ে গেছে তিনি আসলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল। জনপ্রিয় একটা প্রবচন আছে পাকিস্তান সম্পর্কে। প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর আছে একটা রাষ্ট্র, সেটা পাকিস্তান (a state has its army but Pakistan army a state has a state) ইমরান খানের আত্মজীবনীর নাম পাকিস্তান এ পার্সোনাল হিস্ট্রি। এই বইয়ে ইমরান লিখেছেন, আমেরিকা কিছুতেই একটা কথা বুঝতে চাইত না যে পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার বহু জায়গায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীরও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে আল-কায়েদা নেতারা এমনকি ওসামা বিন লাদেন এবং আয়মান আল জাওয়াহিরি ওখানে আছেন বলে আমেরিকানরা দাবি করলেও তাদের ওপর পাকিস্তানের কোনো তথ্য বা নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই এলাকা ছিল পাকিস্তানের অপ্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। পারভেজ মোশাররফ ২০০৪ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনার মাধ্যমে ওই এলাকায় অভিযান চালান। তাতে কিন্তু ওই আল-কায়েদা বিদেশি জঙ্গিরা পারভেজের বিরুদ্ধে চলে যায়। পারভেজকেই হত্যার চেষ্টা করে ওরা। পাকিস্তানকে আমেরিকা তখন চাপ দিয়ে বলছে, ‘Do More’। তাতে কিন্তু পাকিস্তান আরো বিপদে পড়ে বলে ইমরান মনে করেন। ইমরান বলেন, আমেরিকার কথায় আল-কায়েদাবিরোধী অভিযান করতে গিয়ে পাকিস্তানকেও তার অনেক মূল্য চুকাতে হয়েছে। বহু উপজাতি মানুষ নিহত হয়েছে। ওই ফাঁকা এলাকায় লাগাতার বোমাবাজি হয়েছে। উপজাতি এলাকার মানুষ আরো পাকিস্তানবিরোধী হয়ে ওঠে।

ইমরান তার আত্মজীবনীতে আরো লিখেছেন যে জারদারিও আমেরিকার এই তালেবানবিরোধী অভিযানে উপজাতি হত্যার ব্যাপারে কোনো মার্কিনবিরোধী অবস্থান নেননি।
তৎকালীন সিআইএ ডিরেক্টর মাইক হেডেনকে নাকি জারদারি বলেন, ড্রোন আক্রমণ করলে যদি কোল্যাটারাল ড্যামেজ হয় অর্থাৎ সাধারণ উপজাতি মারা যায় তাতে আমেরিকানরা উদ্বিগ্ন হতে পারে। এতে আমার উদ্বেগ হয় না। ইউকিলিক্স কেবল থেকে এসব কথা জানা যায়। ইমরান অভিযোগ করেন, জারদারির কাছে আমেরিকার ডলার পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে বেশি দামি ছিল। জারদারির এই বক্তব্য উডওয়ার্ডের ওবামাস ওয়ার বইটিতে আছে। আর কেবল লিক থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির বক্তব্য জানা যায়। ইমরান বলেছেন, যদি আমেরিকানরা ঠিক লোককে ধরে তবে আমার কিছুই বলার নেই। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রতিবাদ করব, তারপর চুপ করে যাব। কিন্তু ঠিক ঠিক জঙ্গিদের হত্যা করা হবে। ইমরান প্রশ্ন তোলেন, কী করে আমেরিকা নিশ্চিত করবে যে নিহত জঙ্গিদের সঙ্গে নিরীহ মানুষ মারা যাবে না?

ইমরান এই প্রশ্নগুলো কেন তুলেছিলেন? কারণ একটাই। ইমরান দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করেছেন অনেক দিন থেকেই। তাই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং আইএসআইয়ের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন। পারভেজবিরোধী এবং পাঁড় নওয়াজবিরোধী রাজনীতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তুরুপের তাস হয়ে ওঠেন তিনি। তাই আজ তিনি সন্ত্রাস দমনে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন কী করে? মুখে যতই বলুন না কেন, বাস্তবে কি তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করতে পারবেন? তিনি সন্ত্রাস দমনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন অথচ জইশ-ই-মোহাম্মদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে যে পুলওয়ামার ঘটনা তারাই ঘটিয়েছে। এর আগে যখন একই কাণ্ড হয় তখন কিন্তু জইশ এই দাবি করেনি। তাই ইমরান বুদ্ধিমান। অক্সফোর্ডের সাবেক ছাত্র। অক্সফোর্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলার শুরু। কিন্তু বুদ্ধিমান উদার মানুষ হলেও তিনি কিভাবে সন্ত্রাস দমনে ব্যবস্থা নেবেন? আর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ পথে হাঁটবে? ধর্মের সঙ্গে জিহাদকে যুক্ত করে যে কাজ মৌলবাদীরা করছে তার বিরোধিতা করে নতুন পাকিস্তান গড়তে পারবেন ইমরান?
পাশাপাশি বাংলাদেশে মৌলবাদের শিকড় যে নেই, তা তো নয়। মৌলবাদ সব সময় মূলধারার অর্থনীতির মধ্যে মৌলবাদের অর্থনীতি গড়ে তোলে। সরকারের মধ্যে সরকার তৈরি করে ফেলে। রাষ্ট্রের মধ্যে তৈরি করে রাষ্ট্র। শেখ হাসিনা কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন যে মৌলবাদের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মানে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়।

দুর্ভাগ্য আমাদের কাশ্মির এবং পাকিস্তানের লড়াইও চলছে ধর্মের নামে। সাতচল্লিশের স্বাধীনতার সময় থেকেই কাশ্মির ইস্যু নিয়ে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক এক জায়গায়ই আটকে আছে। পাকিস্তানি মদদপুষ্ট আদিবাসী হানাদারের বাধ্যবাধকতায় স্থানীয় মহারাজা হরি সিং ১৯৪৭ সালের বিশেষ পরিস্থিতিতে কাশ্মিরকে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করেন। আদিবাসী হানাদারদের মোকাবেলায় ভারতীয় সেনার সাহায্য দরকার ছিল মহারাজার, আর সে জন্যই ভারতে যোগ দিতে সম্মত হন তিনি। পাকিস্তানের যুক্তি ছিল, কাশ্মিরে মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অঙ্গ করা উচিত। অন্য দিকে দেশভাগের বৈধতা এবং ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্তির শর্তের কথা উল্লেখ করে এ বিশ্বাসে ভারত অটল ছিল যে কাশ্মির অবিসংবাদিতভাবেই তাদের অংশ। উপরন্তু ভারতের বিশ্বাস ছিল, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হিসেবে কাশ্মিরের মর্যাদা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণস্বরূপ।
আমরা এত আধুনিক হলাম, তবু এ সংকট থেকে বের হতে পারলাম না।