ফারুক আজম :
বেঁচে ছিলেন ৭৭ বছর (১৮৯৯-১৯৭৬)। এর মধ্যে মাত্র ২৩ বছরের সৃষ্টিশীল জীবন। তারপর স্তব্ধ হয়ে যান ৪৩ বছর বয়সে ‘চির বিদ্রোহী বীর’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই ২৩ বছরে বেপরোয়া ছিল তার সৃষ্টিশীল ক্ষমতা। পাগলা ঘোড়ার উচ্ছ্বাসে তিনি একের পর সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ছিলেন মত্ত। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার, গীতলেখ্য ও গীতনাট্য রচয়িতা, সুরকার, স্বরলিপিকার, গায়ক, বাদক, সংগীতজ্ঞ, সংগীত পরিচালক, সাংবাদিক, সম্পাদক পত্রিকা-পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র-কাহিনিকার, পরিচালক।
এক অবিসংবাদিত সত্য যে বাঙালির সমগ্র সংস্কৃতিকে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর একজনই সবচেয়ে ব্যাপক-গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তার সেই কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’র ১০০ বছর হয়ে গেল। জনগণের আগ্রহ স্তিমিত হয়নি, বরং বিপুলভাবে মানুষ নেমেছে সেই কবিতার ইতিহাস উদ্ঘাটনে, নতুন চাঞ্চল্যে নতুনরা নতুন করে পড়ছে, আবৃত্তি করছে সেই কবিতাটি।
আমি মনে করি, ‘হেমলেট’ যেমন সব অভিনেতার জন্য চ্যালেঞ্জস্বরূপ, তেমনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি সকল আবৃত্তিশিল্পীর জন্য।
৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষে রাত জেগে ২২ বছরের এক তরুণের কবিতাটি রচনার ইতিহাসের কিছু এখানে সংগৃহীত করছি :

নলিনীকান্ত সরকার সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বিজলী’র ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি সংখ্যায় সেই দীর্ঘ কবিতা প্রথম বেরোল। বাজারে পড়ামাত্র উড়ে গেল, এতই তাড়াতাড়ি যে কদিনের মাথায় ফের ছাপতে হলো ‘বিজলী’র ওই সংখ্যা। সব মিলিয়ে ২৭ হাজার কপি। মাস দুয়েকের মধ্যে মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ‘মোসলেম ভারত’-এর কার্তিক ১৩২৮ সংখ্যা বেরোল, নির্ধারিত সময়ের চার মাস বাদে। তাতেও রইল সেই কবিতা। তার আগেই ‘প্রবাসী’র মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় সেই কবিতার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ‘সাধনা’র বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যা, ‘ধূমকেতু’র ২২ আগস্ট ১৯২২ সংখ্যাÑকোথায় না ছাপা হলো সেই কবিতা! ওই বছর পুজোর মৌসুমে পুরোনো কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হলো সেই কবিতা। কয়েক মাস আগেই ‘একজন সৈনিক’ পরিচয়ে যাঁর ‘শাৎ-ইল-আরব’ কাগজে বেরিয়েছে, এই কবিতার বিপুল জনপ্রিয়তায় তাঁর নাম পাঠকের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল।
ছাপাখানা আসার পর আর কোনো বাংলা কবিতার বরাতে এমন খাতিরদারি জোটেনি বা অখ্যাতির ভাঁড়ার উপচে পড়েনি। আর কোনো কবিতা দশকের পর দশক ধরে পরাক্রান্ত ব্রিটিশ শাসকের খাতায় ‘বিপজ্জনক’ মার্কা পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি আর কোনো কবিকে একটা কবিতার নামে ডাকেনি, নজরুলকে ডাকল। আজও বাংলা ভাষার চিরকালীন বেস্টসেলার ‘সঞ্চিতা’র পাতা ওল্টালে সবার আগে সেই কবিতাতেই চোখ আটকায়। কোথাও না কোথাও থেকে কানে ভেসে আসে কাজী সব্যসাচীর দরাজ গলায় ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ড করা সেই কবিতার আবৃত্তি : ‘বল বীরÑ/ বল উন্নত মম শির!’
১৯২১ সালের শেষ ডিসেম্বরের শেষ রাতে লেখা হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’। ঠিক তার আগের বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ময়দান ছেড়ে এসে কলকাতায় থিতু হওয়ার সময় ‘সৈনিক’ পরিচয়টুকুই সার ছিল তাঁর। ‘মাসিক সওগাত’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘নূর’-এর পাতায় হাত পাকানোর পর ‘মোসলেম ভারত’ ক্রমে তাঁর আত্মপ্রকাশের মুখপত্র হয়ে উঠল। মুজফ্ফর আহমদের সহ-সম্পাদনায় ‘নবনূর’-এর পাতায় তাঁর কট্টর রাজনৈতিক অবস্থান খিলাফত আন্দোলনের আগুন উসকে দিল। অন্যদিকে রবিবাবুর গান ও কালোয়াতি খেয়াল-গজলের গাইয়ে হিসেবে তাঁর নাম ছড়াল কলেজপাড়া, অফিসপাড়ার মেসবাড়ির আসর থেকে ‘ভদ্রলোক’ বাঙালির জলসাঘরে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাগৃহে নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাঁকে ডেকে এনে পাশে বসালেন খোদ রবীন্দ্রনাথ। মাঝে দুই মাসের জন্য কুমিল্লায় গিয়ে বেঘোরে পড়ে তাল কেটেছিল। জুলাইতে সেই মুজফ্ফরের হাত ধরে কলকাতায় ফিরে ৩/৪সি তালতলা লেনের বাড়িতে থেকে শুধু তো ‘বিদ্রোহী’ নয়, ১৯২১-এর আগস্ট থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে নজরুল লিখেছিলেন ‘আনোয়ার’, ‘কামাল পাশা’, ‘শাৎ-ইল্-আরব’-এর মতো কবিতা কিংবা ‘ভাঙার গান’, যার স্মরণীয় প্রথম পঙ্ক্তি ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’। ওই গান আজও সমকালের দাবি মেটাচ্ছে। কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক পাল্টে গেলেও ওরহান পামুকের বয়ানে তার মৌতাত মরেনি।
এসব ছাপিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কীভাবে ১০০ বছরে পাড়ি জমাল এবং এই দেশ এই সময়ের কাছে পুনর্মূল্যায়নের প্রার্থী হলো, তার সুলুকসন্ধান করতে ওই কবিতার কাছেই যেতে হবে। তাঁর জীবন ও সৃজন নিয়ে দুই বাংলাতেই গবেষণা চলেছে। প্রকাশনা হয়েছে। এর সাম্প্রতিক ফসল ঢাকা থেকে বেরোনো গোলাম মুরশিদের জীবনীগ্রন্থ ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’র নামেই ওই কবিতার অমোঘ স্বীকৃতি আছে।
এর পটভূমি কী?
মনে রাখতে হবে, ১৯১১ সালের মাঝামাঝি স্বদেশি আন্দোলনের চাপে পিছু হটে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাতিল করে ব্রিটিশ সরকার। এর পর থেকে বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল, তা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন নজরুল। বর্ধমান তো বটেই, তার আগে ময়মনসিংহের স্কুলে লেখাপড়া করার সুবাদে বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যকে কীভাবে বদলাতে শুরু করেছিল মৌলবাদী আচার-আচরণ, বড় হয়ে উঠেছিল ছোঁয়াছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন। রানিগঞ্জের সিহাড়শোল রাজ হাইস্কুলে ক্লাস টেনের ফার্স্ট বয় যে দুজনের সঙ্গে হরবখত মেলামেশা করতেন, তাঁদের একজন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় বামুন ঘরের ছেলে, আরেকজন শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ কেরেস্তান। এই সাম্প্রদায়িকতাকে তাঁরা তিনজন মেনে নেননি, মনেও নেননি। ম্যাট্রিকুলেশন না দিয়ে বেঙ্গলি রেজিমেন্টে নাম লেখানোর পর করাচিতে দুই বছরের প্রবাসজীবন নজরুলকে রোজকার জাতবিচারের হিসাব থেকে দূরে রেখেছিল। বলশেভিক বিপ্লবের খবর পেয়ে সেনাছাউনিতে মিঠাই বাঁটোয়ারা করেছিলেন যে নজরুল, সেই তিনিই যে একদিন ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ লিখবেন, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! গৈগেরামের গরিব ঘরের ছেলে। শহর কলকাতার কুলীনকুলসর্বস্ব ‘ভদ্রলোক’ হওয়ার দায় নেই। গজদন্ত মিনারে খাসমহল গড়ার ঝামেলা নেই। নাগরিক মেরু বিভাজনের ঊর্ধ্বে যেতে তাঁকে বেগ পেতে হয় না। ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ গোছের উচ্চকিত উচ্চারণ তাঁকে মানিয়ে যায়। বিলিতি ধাঁচের বোলবোলাও নয়, লোকায়তের সুর অনায়াসে বাজে তাঁর লেখায়। ইদানীং নজরুলের গায়ে ‘খাঁটি বাঙালি কবি’ তকমা সেঁটেছেন যতীন সরকার। বেখাপ্পা লাগেনি।
নজরুলের জন্মের ১০০ বছরে তাঁর এক অনন্য মূল্যায়ন করেছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিদগ্ধ অধ্যাপক লিখেছিলেন, ‘নজরুল দেখলেন যে সাম্প্রদায়িকতাটা আসলে সকল হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপার নয়, এটি হলো দুই সম্প্রদায়ের দুই মধ্যবিত্তের ব্যাপার। ওই দুই মধ্যবিত্ত নিজেদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা নিয়ে লড়াই করছে, সেই লড়াইকে তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেছে। তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে গৃহযুদ্ধের দিকে।’
ইতিমধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বলা হয়, তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে জনপ্রিয়। সেই সময় আরেকজন কবি তেমনি জনপ্রিয়, তিনি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। নজরুল ইসলামের অনশনের সংবাদে জেলের বাইরে হাজার মানুষের ভিড়। তারা নজরুলকে দেখতে চায়। প্রাচীরের অপারে দাঁড়িয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি বেঁচে আছেন। জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তির নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। সার্বভৌম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। সুভাষ চন্দ্র তাঁর জাগরণমূলক কবিতা গানের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পেয়েছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সাহচর্য। সমকালীন ফরাসি কবি গিওম আপোলিনেয়ার (১৮৮০-১৯১৮) বা হিস্পানিক কবি ফেদিরিকো গারসিয়া লোরকার (১৮৯৮-১৯৩৬) মতো তাঁরও জীবৎকাল ছিল অল্প দিনের, কিন্তু অসম্ভব বর্ণাঢ্য ও গতিশীল এবং অসম্ভব লোকপ্রিয়।
এই অসামান্য প্রতিভাধর, সৃষ্টি উন্মাদনায় টগবগ করা প্রাণশক্তি কেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন? কবিপৌত্রী খিলখিল কাজী আমাকে বলছিলেন, দাদু বই একবার পড়ে পাতা ছিঁড়ে ফেলতেন, কারণ একবারে তিনি সব স্মৃতিতে গেঁথে ফেলতেন। তাঁর ছিল নানা ধরনের বইয়ের সংগ্রহ। তাঁর একজন সহচর জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি এত সব বই পড়বেন কখন? তিনি উত্তর দিলেন, আমার পড়া হয়ে গেছে।’ এমনই মেধাশক্তি।
১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর, ১৩৬ বঙ্গাব্দের ১৯ অগ্রহায়ণ রোববার কলকাতা এলবারট হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বিপুল সমারোহ ও আন্তরিকতাসহকারে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা সভার সভাপতি বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অভিভাষণের পর জাতির পক্ষ থেকে ‘নজরুল সংবর্ধনা সমিতির সভ্যবৃন্দ’ কবিকে একটি মানপত্র প্রদান করেন। অভিভাষণের উত্তরে কবি দেন ‘প্রতিভাষণ’। এরপর সুভাষ চন্দ্র বসু আবেগোচ্ছল কণ্ঠে কবির স্বদেশি সংগীত ও দেশাত্মবোধমূলক কবিতার প্রশংসা করে এক বক্তৃতা দেন। সেই প্রতিভাষণে কবি বলেন, ‘আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজের নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। যে কূলে যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ এই একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে পারি, তিনি এখনো কতটা সমসাময়িক।
তিনি বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো, কিটসের মতো খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ।’
কবিগুরু কেন এ কথা বলেছিলেন? তিনি কি ভবিষ্যদ্রষ্টা ছিলেন? পার্সি বেসি শেলি এবং জন কিটস দুজন উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যের অমর কবি। দুজনের হয় অকালমৃত্যু। শেলি ও কিটসের জীবন জর্জরিত ছিল দেনায়, ভগ্নস্বাস্থ্য, ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধতায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শেলির দ্বিতীয় স্ত্রী মেরি শেলি লিখেছিলেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। শেলির মৃত্িয নৌকা দুর্ঘটনায় মাত্র ২৯ বছর বয়সে। কিটস মারা যান ২৫ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে। এই দুই কবির সঙ্গে নজরুলের এই পার্থক্য, এঁরা জীবিত অবস্থায় কোনো স্বীকৃতি পাননি কিন্তু নজরুল জীবিত অবস্থায় ছিলেন খ্যাতির এবং জনপ্রিয়তার শিরোমণি।
ট্র্যাজেডি-অসুস্থতা
১৯৪২ সালে ৪৩ বছর বয়সে কবি এক অজানা রোগে ভুগতে শুরু করেন, তাঁর কণ্ঠস্বর ও স্মৃতিশক্তি হারান। ভিয়েনার এক মেডিকেল টিম এই রোগটিকে ‘পিকস ডিজিজ’ হিসেবে চিহ্নিত করে, এটি এক বিরল দুরারোগ্য নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ। এটি নজরুলের স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি ঘটায় এবং তাকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে বাধ্য করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরলোকগত হন ৮ আগস্ট ১৯৪১। কবি নজরুল ইসলাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঠাকুরের স্মৃতিতে দুটি কবিতা রচনা করেছিলেন, যার একটি ‘রবিহারা’, অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রচারিত হয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যে নজরুল নিজেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে বাক্্শক্তি হারাতে থাকেন। তার আচরণ অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং বেপরোয়াভাবে ব্যয় করতে গিয়ে তিনি আর্থিক সমস্যায় পড়ে যান। আকস্মিকভাবে তার সক্রিয় জীবন হারিয়ে ফেলায় ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুল তার বন্ধু জুলফিকার হায়দারকে ১৭ জুলাই ১৯৪২ সালে এক চিঠিতে লিখেছিলেন :
‘রক্তচাপের কারণে আমি বিছানায় শুয়ে আছি। অনেক কষ্টে লিখছি। আমার বাড়ি দুশ্চিন্তায় ভরাÑঅসুখ, ঋণ, পাওনাদার; দিনরাত আমি সংগ্রাম করি… আমার স্নায়ু ভেঙে গেছে। গত ছয় মাস ধরে আমি প্রতিদিন হক সাহেবের কাছে যেতাম এবং ভিখারির মতো ৫-৬ ঘণ্টা কাটাতাম। আমি মানসম্মত চিকিৎসা সহায়তা পেতে অক্ষম…এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি। খুব কষ্টে আমি কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারি। আমি প্রায় সারা শরীরে ব্যথা অনুভব করছি। জানাজার নামাজের দিন কবি ফেরদৌসীর মতো টাকা হয়তো পাব। যাই হোক, আমি আমার আত্মীয়দের সেই টাকা প্রত্যাখ্যান করতে বলেছি। ইতিÑনজরুল।’
কলকাতার বিশিষ্টজনদের উদ্যোগে ১৯৫২ সালের জুনে কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসায় গঠিত হয় ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’। কমিটিতে ছিলেন অতুল গুপ্ত, কাজী আবদুল ওদুদ, সজনীকান্ত দাস, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সমিতির উদ্যোগে চিকিৎসার জন্য রাঁচির ‘হসপিটাল ফর মেন্টাল ডিজিজেস’-এ (এইচএমডি) পাঠানো হয় কবিকে, ২৫ জুলাই। সুস্থ অবস্থায় নজরুল বহুবার গিয়েছেন রাঁচিতে, জানা যায় তাঁর পালিতা কন্যা শান্তিলতা দেবীর লেখায়। কল্যাণী কাজী সম্পাদিত ‘নজরুল, দ্য পোয়েট রিমেম্বার্ড’ গ্রন্থে জানা যায়, ৩ নম্বর কটেজে ছিলেন কবি। শান্তিলতার মতে, সাহেব ডাক্তাররা তাঁকে যত্ন নিয়ে দেখতেন, কবি সেখানে ছিলেন এক বছরেরও বেশি। তবে মাহবুবুল হক রচিত ‘নজরুল তারিখ অভিধান’ গ্রন্থের তথ্য : অধ্যক্ষ মেজর ডেভিস রোগ নির্ণয়ে অপারগ হন, চার মাস চিকিৎসাতেও উন্নতি না হওয়ায় নজরুলকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায়। ১৯৫৩ সালের ১০ মে নিরাময় সমিতির উদ্যোগে সহ-সম্পাদক রফিকউদ্দীন আহমদ কবিকে নিয়ে পাড়ি দেন লন্ডনে, ‘জল আজাদ’ জাহাজে চেপে’।
ইউরোপে নজরুলের চিকিৎসা
১৯৪২ সালের জুলাই মাসে যখন নজরুলের অসুস্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন তিনি চিকিৎসাসেবা পেয়েছিলেন, কিন্তু তা ছিল অপর্যাপ্ত এবং সময়োপযোগী ছিল না। তার পরও কিছু চিকিৎসক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ইতিমধ্যেই হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। কবিকে যদি সেই সময়ে ইউরোপে পাঠানো যেত, তিনি হয়তো নিউরোসার্জারি পেয়েছিলেন। তবে সম্পদের সদ্ব্যবহার করা গেলেও কবিকে ইউরোপে পাঠানো যায়নি, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে চলছে। নজরুল চিকিৎসা কমিটি অনেক দেরিতে সংগঠিত হয়েছিল, ১৯৫২ সালের জুন মাসে। কবি ও তার পত্নী রাঁচি স্যানিটোরিয়ামে চার মাস কাটিয়েছিলেন, তাদের দুজনকেই মে ১৯৫৩ সালে লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল।
লন্ডন ক্লিনিকে, লন্ডনের একটি হাসপাতালে, কবির এয়ার-এনসেফালোগ্রাফি এক্স-রে করা হয়েছিল… যা নির্দেশ করে, কবির মস্তিষ্কের ‘ফ্রন্টাল লোব’ সংকুচিত হয়েছে। …বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, যেমন ডা. ম্যাককিস্ক, ‘ম্যাককিস্ক অপারেশন’ নামে একটি পদ্ধতির সুপারিশ করেছেন। …তবে ডা. ব্রেন সেই সুপারিশের বিরোধিতা করেছিলেন।
সেই সময়ে, কবির চিকিৎসা ডসিয়ার ভিয়েনার বিখ্যাত চিকিৎসকদের পাশাপাশি ইউরোপের অন্যান্য প্রধান স্থানে পাঠানো হয়েছিল। প্রফেসর রোয়েটগেন জার্মানির বন ইউনিভার্সিটির নিউরোসার্জারির একজন অধ্যাপক যুক্তি দিয়েছিলেন, ম্যাককিস্ক অপারেশন কবি নজরুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। ভিয়েনার নিউরোসার্জনও ডা. ম্যাককিস্কের সুপারিশের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তারা তিনজনই তাঁর মস্তিষ্কের সেরিব্রাল এনজিওগ্রাফি নামের একটি পরীক্ষার সুপারিশ করেছিলেন। কবির শুভাকাক্সক্ষীদের সম্মতিতে কবিকে ভিয়েনায় ডক্টর হ্যান্স হফের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করা হয়েছিল, একজন প্রখ্যাত নিউরোসার্জন, যিনি নোবেল বিজয়ী জুলিয়াস ওয়াগনার-জাউরেগের একজন বিশিষ্ট ছাত্রও ছিলেন। ১৯৫৩ সালের ৯ ডিসেম্বর কবি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করার পর ড. হফ দৃঢ়ভাবে মতামত দেন, কবি পিকস ডিজিজ নামে একটি নিউরো-ডিজঅর্ডারে ভুগছেন। এ ধরনের রোগীদের মস্তিষ্কের সামনের এবং পাশের লোবগুলো সংকুচিত হয়। …ডা. হফের মতে, অসুস্থতা এতটাই বেড়েছে যে রোগীর কার্যত সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
১৯৬২ সালের ৩০ জুন তাঁর স্ত্রী প্রমীলা মারা যান। নজরুলকে নিবিড় চিকিৎসায় রাখা হয়েছে। ১৯৭২ সালে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ভারত সরকারের কাছ থেকে নজরুলকে ঢাকায় বসবাসের অনুমতি দেয় এবং তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। চিকিৎসা ও মনোযোগ পাওয়ার পরও নজরুলের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ সালে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র একজন প্রখ্যাত গিটারিস্ট কাজী অনিরুদ্ধ মারা যান এবং নজরুল অনতিবিলম্ব পরেই ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ তার দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করন। তার একটি কবিতায় তিনি যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, সে অনুযায়ী তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। বাংলাদেশ দুই দিনের জাতীয় শোক পালন করে এবং ভারতীয় সংসদ তার সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করে। ১৯৭৯ সালে তাঁর শেষ জীবিত পুত্র সব্যসাচী মারা যান।
কবি যেন নিজের ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন :
‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।
নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিঁধুর ধূপ।’
তথ্য সংগ্রহ :
আব্দুল মানান সৈয়দ
আনন্দবাজার
ডা. ওমর ফারুক
মুজাফফর আহম্মদ
এনসাইক্লোপেডিয়া
উইকিপিডিয়া
লেখক : চিকিৎসক, কবি ও কলামিস্ট