সংঘাতের পথে রাজনীতি

দুই মেরুতে দুই দল জনমনে শঙ্কা

নূরুল ইসলাম : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব ততই বাড়ছে। রাজনীতিতে ক্রমেই উত্তাপ ছড়াচ্ছে দল দুটি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, দুই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তৃতা-বিবৃতি আর দুই দলের দুই মেরুতে অবস্থানের কারণে দেশের সাধারণ মানুষ শঙ্কিত। তারা দেশে ফের রাজনৈতিক সহিংসতার আলামত দেখে উদ্বিগ্ন। আগামী নির্বাচন কেমন হবে, কবে হবে, কার অধীনে হবে, বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনে আসবে কি না- এমন বহু প্রশ্ন দেশবাসীর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো প্রতিদিনই নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে। আবার ক্ষমতাসীন দলও স্পষ্ট করেই বলছে, আগামী নির্বাচন হবে সংবিধানের আলোকেই। অর্থাৎ বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, এর বাইরে কিছুই নয়। সরকার ও বিরোধী পক্ষের বিপরীতমুখী এই অবস্থান শেষ পর্যন্ত কোন পথে সমাধান হবে- তা নিশ্চিত নন রাজনীতিক বা নাগরিক সমাজের কেউই।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনে অংশ নিতে যাবতীয় প্রস্তুতি রয়েছে আওয়ামী লীগের। আমরা বিএনপিকে প্রথম থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিযোগিতায় চেয়েছি। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগকে শত্রু মনে করে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, তার দলের পক্ষ থেকে ঘোষিত ১০ দফা দাবি আদায়ের আগে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না তারা। তিনি বলেন, ‘আমাদের সাফ কথা, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাব না। আগে ১০ দফা বাস্তবায়ন, তারপর নির্বাচন।’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত বিধানাবলি অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদপূর্তির আগের ৯০ দিন সময়কালের মধ্যে সংসদ বহাল থাকাবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী-পরবর্তী প্রণীত বিধানাবলির আলোকে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ও তার মিত্ররা এখন রাজপথে যে ১০ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে রয়েছে, সে ১০ দফা দাবি আদায় না হলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও দশম ও একাদশ সংসদের মতোই অনুষ্ঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন ইস্যুতে দুই মেরুতে থাকা দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের শঙ্কা দেখা দেবে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে এ বছরের নভেম্বর মাস থেকে। আইন অনুযায়ী ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ততই বাড়ছে। আগামী নির্বাচনে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হবে কি না, সীমানা কেমন হবে, তা নিয়ে বিরোধী দলগুলোর এখন খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বিরোধীদের লক্ষ্য নির্বাচনকালীন সরকার হতে হবে নির্দলীয়। সেই সরকারকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী পশ্চিমা কূটনীতিকেরা সাত মাস আগে ইসির সঙ্গে বৈঠক করেন। গত ১৮ জানুয়ারি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) হেড অব ডেলিগেশন চার্লস হোয়াইটলির নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে। ‘মতপার্থক্য ভুলে সব দল নির্বাচনে আসবে’ নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের এমনটাই জানানো হয়। ইইউ প্রতিনিধিদল মূলত নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। তাদের ভোটার তালিকা (ইলেকট্রোরাল রোল), সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ইসির উদ্যোগগুলো তাদের জানানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ইইউকে তখন জানিয়েছিল, দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ আছে, সেগুলো রাজনৈতিক ইস্যু। এগুলো আমাদের জন্য ইস্যু নয়। কাজেই সেই পলিটিক্যাল ইস্যুগুলো, যেগুলো ইলেকশনের জন্য অন্তরায় হতে পারে, সেগুলোর সুরাহা রাজনৈতিক নেতাদেরই করতে হবে। তাহলেই নির্বাচন প্রত্যাশিত মাত্রায় অংশগ্রহণমূলক হবে, সুন্দর ও সুষ্ঠু হবে।
কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে সরকারি ও বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ ততই বাড়ছে। পলিটিক্যাল ইস্যুগুলো সুরাহার পরিবর্তে আরও জটিল হচ্ছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। তাই সামনের দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা নিয়ে যুগপৎ উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত দেশবাসী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন চলতে থাকলে দেশ ভয়াবহ সংঘাতের দিকে চলে যাবে। বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। তাই সরকার ও বিরোধী দল সবার উচিত সংঘাত এড়িয়ে চলা। নির্বাচনের এখনো এক বছর বাকি। এখনই রাজপথ দখল নিয়ে সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়লে তা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। প্রতিটি দলের সংবিধান অনুযায়ী সভা-সমাবেশ করার মৌলিক অধিকার রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করলে সাধারণ মানুষের আরও কষ্ট বাড়বে। তবে বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন দলকে ছাড় দেওয়া উচিত। তাদের পাল্টা কর্মসূচিতে সংঘাত আরও বাড়তে পারে।