লতিফা চৌধুরী
আমাদের মহানবী (স) শিশু-কিশোরদের অকৃত্রিমভাবে স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের জন্য মহান আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ রহমত এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসূল। তাঁর জন্ম অনেকদিন আগে, পবিত্র কাবা ঘরের পাশেই তাঁর দাদার বাড়িতে। দাদার নাম আবদুল মোতালিব। বাবার নাম আবদুল্লাহ্। মায়ের নাম আমিনা। তাঁর জন্মের আগেই তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর জন্মের সময় পৃথিবীতে এলো এক মহা-আনন্দের খবর। চাঁদ-তারা-ফুল সবকিছু যেন একসঙ্গে খুশিতে নেচে উঠলো। ধরাধামে তাঁর আগমন সম্পর্কে আমাদের
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন: ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, মধু পূর্ণিমারই চাঁদ দোলে, যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে ফুল মখলুকাতে ধ্বনি ওঠে কে এলো ঐ আকাশ গ্রহ তারা পড়ে লুটেকে এলো ঐ —। আরবের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী হালিমা নামের এক ধাত্রীর গৃহেই শিশু মহানবী (সঃ) লালিত-পালিত হন এবং দাদা আব্দুল মোত্তালিব আর চাচা আবু তালিবের আদরে তার শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়। হালিমা খুব ধনী ছিলেন না, বেশ কষ্টেই তার সংসার চলতো। কিন্তু নবী (স)কে ঘরে নেয়ার পর হালিমার উট, প্রচুর পরিমাণে দুধ দিতে লাগলো। মাঠে ফসল ফলতে শুরু করলো। হালিমা বিশ্বাস করলোÑ এই শিশু পুত্র তার ঘরে প্রাচুর্য এনে দিয়েছে, এখন তার কোন দুঃখ নেই।
শিশু মোহাম্মদ (দ.) দিনের বেলা সমবয়সীদের সঙ্গে মাঠে মেষ চরাতেন ও খেলাধূলা করতেন। তবে কখনো তিনি কারও সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি করতেন না। তিনি সব সময় সত্য কথা বলতেন। তার সত্যবাদিতার জন্য মক্কার লোকেরা তাঁকে ‘আল আমীন’ অর্থাৎ বিশ্বাসী উপাধী দিয়েছিল। তারা তাদের টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ এই বালকের কাছে জমা রাখতো। পরে তারা যখন সেসব ফেরৎ চাইতো, তিনি সবকিছু ফেরৎ দিতেন। কিশোর বয়সে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে ব্যবসার কাজে তিনি অন্য দেশেও যেতেন। এক পর্যায়ে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে তার নাম সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পরলো।
একদিন মাঠে মেষ চরাণোর সময় অকস্মাৎ আল্লার পাঠানো ফেরেশতা মাঠে উপস্থি হয়ে মোহাম্মদকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন এবং বুকের মাঝখানে ছুরি চালিয়ে দু’ফাঁক করে তাঁর সিনাহ তিনবার পবিত্র পানি দিয়ে ধুয়ে দিলেন। তারপর আবার তাঁকে আগের মত সুস্থ করে দিলেন। এই ঘটনা তার বন্ধুরা দূর থেকে দেখে ভয় পেয়েছিল। তখন থেকে তার হৃদয়ে আর কোন হিংসা, রাগ, অন্যায় রইলো না। তিনি হয়ে গেলেন অতি পবিত্র!
২৫ বছর বয়সে মক্কার ধনী ও গুণবতী নারী খাদিজার ইচ্ছায় তিনি তাকে বিয়ে করে ঘর সংসার করলেন। তাঁদের মেয়ে মা ফাতিমা (রা.)। এই ফাতিমার সন্তান কারবালা প্রান্তরে শহীদ হযরত হাসান আর হোসেন (রা.)। মহানবী (স) এর অকৃত্রিম বিশ্বস্ত সাহাবী হযরত আলী (রা.) ছিলেন তাদের বাবা। মহানবী (স) সবসময় অন্ধকারাচ্ছন্ন ও পথভ্রষ্ট আরববাসীর কল্যাণের জন্য ভাবতেন। মাঝে মাঝেই তিনি মক্কার হেরা পর্বতের গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হতেন। এমনি এক ধ্যানমগ্ন মুহূর্তে মহান আল্লাহর বাণী নিয়ে হেরা গুহায় আগমন করলেন ফেরেশতাদের সর্বার হযরত জিব্রাইল (আ)। তিনি মোহাম্মদ (দ.) কে বললেনÑ পড়। তিনি উত্তরে বললেন- আমি তো পড়তে জানি না! তখন জিবরাইল (আ) তাঁকে তিনবার বুকের মধ্যে খুব জোরে চেপে ধরলেন, তিনি তার শেখানো কথা পড়তে পারলেন। তখন নবীর বয়স ছিল ৪০ বছর। তখন থেকেই তিনি নবুয়ত পেলেন। মানুষকে বোঝাতে লাগলেন ‘আল্লাহ এক’- সব ক্ষমতা শুধু একমাত্র তাঁরই। আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করতে গিয়ে আরবের প্রভাবশালী পৌত্তকিদের পক্ষ থেকে তাঁকে নানা প্রতিকূলতা ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পৌত্তলিকরা মহানবী(স) সর্বদা বিব্রত ও নানাভাবে নির্যাতন করত। এমনকি তাঁর প্রাণ নাশেরও প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু তারপরও তিনি তার কাজ করেই গেছেন। মানুষকে ঠিক পথে, সত্যের পথে নিয়ে আসার জন্য এক পর্যায়ে মক্কার কিছু বিধর্মী মানুষের অত্যাচারে তিনি মদিনায় যেতে বাধ্য হলেন। মদিনায় তার অনেক বন্ধু হলো- তারা ছিল মুযাহিদ, আনসার। আস্তে আস্তে তার কথা সবাই মানতে আরম্ভ করলো। তখন তিনি আবার একদিন তার জন্মভূমি মক্কায় ফিরে এলেন অনেক সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে। মক্কার শত্রুরা ভয় পেলো, তারা ভাবলো এবার তাঁদের রেহাই নেই! তারা ঘরের দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকলো। কিন্তু আমাদের নবী (দ.) কোন প্রতিহিংসা দেখালেন না, সবাইকে ক্ষমা করে ছিলেন! তখন সমস্ত মক্কার লোক এসে তার দলে যোগ দিলÑ অর্থাৎ আল্লাহয় বিশ্বাস করলো। কাবায় হজ্ব করলো সবাই এক সাথে- সমস্ত অন্যায় দূর হলো। এই নবীর কল্যাণে যেন দুনিয়াটাই বেহেশতে পরিণত হলো। আমাদের মহানবী (স) শিশু-কিশোরদের খুব ¯েœহ করতেন। তাঁর নাতি হাসান-হোসেনকে তার পিঠে বসিয়ে নিজে ঘোড়া হতেন আনন্দ দেবার জন্য। রাস্তায় চলার সময় বাচ্চাদের দেখলে তিনি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন। বাচ্চারা নবীকে দেখলে আনন্দে নেচে উঠতো, গান গাইতো। তিনি কখনো কারো নামে খারাপ কিছু বলতেন না। তার সেই ছোটবেলার দুধ মা হালিমাকে তিনি খুব সম্মান করতেন নিজের মায়ের মতই। নিজের মাকে হারাণ মাত্র ছয় বছর বয়সে, তাই হালিমাই ছিল তার কাছে মায়ের মত।
মহানবী (স) এর নাম শুনামাত্রই তাঁর উম্মতদের অবশ্যই দরুদ পড়তে হবে। দরুদটি হলোÑ সাল্লেল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কারণ এই পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে কৃপণ, যারা নবীর নামে দরুদ পড়ে না। দরুদ পড়লে নবী খুশি হন এবং আল্লাহ্ও খুশি হন। তিনি ছিলেন মহান আল্লাহরও বন্ধু। একবার আল্লাহ্ তার বন্ধুকে তাঁর সমস্ত সৃষ্টি, যেমন বেহেশত-দোজখ, আকাশ-বাতাস সবই দেখিয়ে দেয়ার কথা ভাবলেন। সেই মত একরাত্রে নবী (দ.)-কে সেই জিবরাইল ফেরেশতা এসে মক্কা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন বাইতুল মোকাদ্দাসে। তারপর সেখান থেকে বোরাক নামক খুব দ্রুতগতির একটি বাহনযোগে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো আল্লার সঙ্গে কথা বলার জন্য। সেই রাত্রিটি ছিল শবে কদরের রাত্রি। ঐ রাতেই আল্লাহ মানুষের জন্য নির্দেশনা দিয়ে কোরআন পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। আমরা সেই কোরানের কথা মতই সব কাজ করার চেষ্টা করি । নবী সেই রাত্রে মানুষের জন্য মাত্র পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ আল্লাহর কাছ থেকে কবুল করিয়ে এনেছিলেন।
-ওয়াশিংটন ডিসি।