বাংলাদেশে সম্প্রতি রাজনীতিবিদের চেয়েও অধিক আলোচনা-সমালোচনা হয় সরকারি আমলা গোষ্ঠীকে নিয়ে। গণধারণা হচ্ছে, সচিব বা সরকারি বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় বড় কর্তাব্যক্তিদের কারণেই নাকি জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। যে সুশাসন ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দর্শন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্তÑমুক্তিযুদ্ধের সেই দর্শন, গণতন্ত্রের শর্তÑসমাজে তা অপূর্ণই রয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, সরকারের ওপর আমলাদের কর্তৃত্বপরায়ণতা এতটাই দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যে অতি সাধারণ মানুষও আমলাতন্ত্র নিয়ে সমালোচনামুখর। তাদের ধারণা, রাজনীতিবিদেরা এখন আর দেশ চালান না। শীর্ষ নেতা-নেত্রীরাও দলীয় নেতা-কর্মীদের কথা বা পরামর্শ শোনেন না। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত করিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও রাখে ওই আমলা গোষ্ঠী।
বর্তমানে চলমান এই পরিস্থিতি যে সরকারের গণসমর্থন অনেক দুর্বল করে দিচ্ছে, পরিস্থিতিটা সরকারের উচ্চ মহল সম্ভবত অনুধাবন করতে পারছে। তাই তো স্বেচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক কিংবা কৌশল হিসেবে হোক, পরিস্থিতি সামাল দিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে সচিবদের সতর্ক করে দিতে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছে। বিশেষ করে, এখন যখন নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিবিদদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সময় এসেছে, তখন তারা সচিবদের চলার গতিতে কিছু ছেদ টানা খুব দরকার বলে মনে করছেন নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার জন্য।
সবকিছু মাথায় রেখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিবদের সতর্ক করে দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘স্বাক্ষর যার দায়িত্ব তার’। গত ২৬ সেপ্টেম্বর সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিবদের সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছে, বিদেশি ঋণচুক্তি প্রকল্প বাস্তবায়ন বা নীতিনির্ধারণ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সচিবদের আরও সতর্ক হতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘শুদ্ধাচার কৌশল’ বিষয়ক এক কর্মশালায় সচিবদের এই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যারা যে কাজের জন্য স্বাক্ষর করবেন, দায় তাদের ওপরই বর্তাবে। তাই আইনবিধি না বুঝে কোনো কাজ করবেন না। এতে দেশের ক্ষতি হয়।’
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। ঋণ বা অনুদান যে ধরনের প্রকল্পই হোক, সেটি দেশের স্বার্থে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, অনেক সচিব আছেন, যারা বিদেশি চুক্তি করার আগে সেটি পড়েও দেখেন না।
চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, ‘প্রকল্প যেমনই হোক, সেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও
সংঘাতের কোনো বিষয় যাতে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। যে দেশের ঋণ, সে দেশের পরামর্শক, আবার সেই দেশ থেকেই কেনাকাটা-এগুলো স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। মনে রাখতে হবে, দেশের প্রতিটি টাকা সাধারণ মানুষের পকেট থেকে আসে। এর সদ্ব্যবহার করা আমাদের দায়িত্ব।’
দেশি অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে সচিব খন্দকার ইসলাম উল্লেখ করেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘দেখা যায়, এক দপ্তরের কাজ অন্য দপ্তর দিয়ে করানো হচ্ছে। আইন মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা নিয়ম মেনে চলতে পারবেন না, দায় তাদেরই নিতে হবে।’ তিনি দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এসব কথার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এত দিন সচিবরা কীভাবে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তারা যে কোনো কিছুই তোয়াক্কা করতেন না, নিয়মনীতি মেনে চলতেন না, কোনো জবাবদিহির মধ্যে তারা ছিলেন না, নিজেদের খুশিমতো কাজ করে যেতেন-এটা বুঝতে কারও এখন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
এ কথা কোনো দ্বিধা না নিয়েই বলা যায়, সচিবদের যে নিয়মবিধি মেনে চলার কথা, তারা সেভাবে মোটেও চলতেন না। তাদের কাছে জনগণ, জনস্বার্থ সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। বর্তমান সময়ে মনে হয়, সরকারের আর কোনো অঙ্গই সচল নেই। সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী আর তার পরেই আমলাতন্ত্র। এর মাঝখানে জনগণ বা আর কোনো কিছু নেই। আমলাতন্ত্রের মধ্যে সামরিক, বেসামরিক, টেকনোক্র্যাট সকল আমলাই অন্তর্ভুক্ত। ডিফ্যাক্টো নির্বাহী যেন আমলারা। জনগণের কাছে ন্যূনতম জবাবদিহিও দেখা যায় না আমলাদের। আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, কতিপয় আমলার জবাবদিহিহীন কার্যকলাপ জনগণের সরকারকে জনগণেরই মুখোমুখি করে দিয়েছে।
সম্প্রতি সংসদে এবং সংসদের বাইরে অনেক পোড় খাওয়া প্রবীণ রাজনীতিবিদ যাদের অবদানে ও সাংগঠনিক দক্ষতায় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, তাদের অনেকের মুখেই আলোচনা শোনা গেছে, আজকাল তাদের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাদের মধ্যে বিস্তর গ্যাপ। তারা কোনো কথা বলার সুযোগ পান না প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। কোনো পরামর্শ দেওয়ার সুযোগও পান না। তারা ব্যাকবেঞ্চার। রাজনীতিও নির্বাসিত। পরিস্থিতি আজ এতটাই ভয়াবহ যে এই আমলাচক্রের কারণেই ‘রাজনীতিবিদেরা এখন কেষ্ট। আর নেপোয় মারছে দই’।
অনেক সমালোচকই বলে থাকেন, জনগণের সরকার আজ কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত হতে চলেছে। সরকার তার সকল কর্তৃত্ব প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ যাদের মাধ্যমে, তাদের মধ্যে প্রধানত এবং শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে আমলাতন্ত্র। কলকাঠি নাড়বেন তারা, মেধা ও প্রভাব খাটিয়ে কাজ করিয়ে নেবেন তারা এবং মানুষের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি করবেন তারা। অথচ সমালোচনা এবং ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকবেন তারা।
তবে এক থেকে একশÑসকল সচিব বা আমলাকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না। দেশপ্রেমিক এবং গণবান্ধব আমলা-কর্মকর্তার সংখ্যাও কম নেই। ‘শুদ্ধাচার কৌশল’ বিষয়ক কর্মশালায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব যে উপলব্ধির কথা বলেছেন, সেদিকে মনোযোগ দিয়ে আমলাদের জনগণের প্রকৃত সেবক হিসেবে কাজে লাগিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হবে এ সময়ের প্রধান দাবি। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সব সময় আদর্শ হচ্ছে এটাই, রাজনীতিবিদ তাদের নীতি-আদর্শ মেনে কাজ করবেন, আমলারাও রাষ্ট্রের সেবক হয়ে কাজ করে যাবেন। সাধারণ মানুষেরও এর চেয়ে বড় প্রত্যাশা আর কিছু নেই। নিজের স্বার্থ, উচ্চাকাক্সক্ষা সামান্য কিছু বিসর্জন দিতে পারলেই দেশের ও মানুষের অনেক কল্যাণ করা যায়। লোভ ও ব্যক্তিস্বার্থের গহ্বরে একেবারে নিমজ্জিত না হলেই হয়। এটুকু অন্তত দেশের জন্য সবাই যদি ত্যাগ করেন, তবে সবদিকেই মঙ্গল হয়। ৩০ লাখ মানুষের জীবন এবং ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়ে পাওয়া বাংলাদেশের মানুষ এটুকু প্রত্যাশা সকলের কাছেই করতে পারে।