সত্তরের দশকের কম্পিউটার বিশ্বে সামসুন্নাহার রেণু

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার আমানউল্লাহ হাজরা নিজের সরকারি চাকরির তাগিদেই শুধু নয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় যোগ্য করে তোলার অদম্য ইচ্ছা থেকে এক সময় ঢাকায় এসে নিজস্ব নিবাস তৈরি করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। খাদ্য বিভাগের সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমানউল্লাহ বিভিন্ন সময় দেশের অন্যান্য জায়গায়ও বদলি হয়ে ঢাকার বাইরে চলে যেতেন।

যোগ্য গৃহিণী সুরাইয়া হাজরা ছেলেমেয়েসহ পুরো সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করতেন। এই দম্পতির সাত সন্তানের মধ্যে সামসুন্নাহার তৃতীয়। তৎকালীন অভিভাবকরা সন্তানদের যথার্থ মানুষ গড়ার চিন্তা থেকেই তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে-আস্থা রেখে পুরো জীবনকে মানবিক মহিমায় উদ্বুদ্ধ করতে প্রেরণা যোগাতেন। প্রাসঙ্গিকভাবে শিক্ষার ব্যাপারটিও সেই বোধে চালিত হতো।

পিতা সরকারি কর্মকর্তা, তার ওপর বদলির চাকরি। মা গৃহিণীপনায় সিদ্ধহস্ত। ফলে সংসারকে কেন্দ্র করেই তার সমস্ত মনোযোগ আর নিবেদন। সন্তানদের অজান্তেই তাদের ওপর কড়া নজর রাখাও ছিল বাবা-মায়ের বিশেষ দায়বদ্ধতা। শুধু ওইটুকুই, তার বেশি নয়। ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবনে নিজেরাই ছিল নির্ণায়ক। সামসুন্নাহার রেণুও বাবা-মায়ের স্নেহছায়ায় নিজের লক্ষ্যে চালিত হয়ে শিক্ষা জীবনের প্রয়োজনীয় সময়টুকু পার করেছেন।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সারা বাংলা যখন বিক্ষোভে তোলপাড় সে সময়ই তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। ১৯৬৯ থেকে ’৭২ জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরে ’৭২-এ সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের আনন্দযোগের সঙ্গে হরেক রকম সমস্যা-সঙ্কট উত্তরণের এক ক্রান্তিলগ্ন।

গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সামসুন্নাহার সেই পালাক্রমের পথযাত্রায় নতুন আর এক ঘটনার মুখোমুখি হন। ১৯৭২ সালের নবেম্বর মাসে বিয়ে হয়ে যায় বুয়েটের শিক্ষক মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে। যিনি তখন কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে কানাডার উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত। ফলে বিয়েটাও হয় খুব সাধারণভাবে টেলিফোনে।

এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের আগস্টে এক সময় তিনিও চলে যান কানাডায়। তখন অবধি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন ডিগ্রিই নেয়া সম্ভব হয়নি। নিজেকে তৈরি করার অদম্য স্পৃহা আর সাহস থেকেই তিনি নতুন করে ভাবর্তে থাকলেন তার শিক্ষা জীবনকে কিভাবে চালিত করা সম্ভব। স্বামীর সহযোগিতা তো ছিলই বাকিটা নিজের উদ্যোম আর দৃঢ় মনোভাব। স্বামীর বিষয় আর নিজের অর্জিত শিক্ষার মধ্যে ফারাকের কারণে প্রথমে কিছুটা হিমশিম খেলেও পরে ঘুরে দাঁড়াতেও সময় লাগেনি। গণিতের ছাত্রীর সামনে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হলো।

কম্পিউটার বিজ্ঞান, তখন অবধি যে শব্দটি অতটা প্রচলিত না। ডধঃবৎ ষড়ড়তেই সুযোগ তৈরি হলো এই নতুন তথ্যপ্রযুক্তিতে শিক্ষালাভ করার এক সুবর্ণ অধ্যায়। গল্পচ্ছলে বলছিলেন কম্পিউটারের ‘ক’ও জানেন না তিনি। বিজ্ঞানটিরও তখন মাত্র যাত্রাকাল, তার পরেও নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এই আধুনিক বিজ্ঞানকে পাথেয় করে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করলেন। চৎড়ভভব জবষষু-এর কর্তৃক নির্বাচিত ৮টি কের্সের ওপর তাকে এই নতুন তথ্যপ্রযুক্তির অধ্যয়নে নিয়োজিত হতে হয়। শুধু তাই নয়, প্রতিটি কোর্সে তাদের নির্ধারিত অ গ্রেড পাওয়াও ছিল এর আবশ্যকীয় পূর্ব শর্ত। বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত গ্রেড অর্জন করে সফলভাবে নিজেকে যোগ্যও প্রমাণ করলেন। অর্জিত হলো স্নাতক ডিগ্রি।

পরে বছরব্যাপী নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হয় আরও উচ্চতর গবেষণার কাজে। এখানে প্রজেক্ট নিয়ন্ত্রিত গবেষণায় যুক্ত হয়ে উত্তীর্ণও হন অত্যন্ত সফলভাবে। ১৯৭৭ সালে ডধঃবৎ ষড়ড় থেকে ডিগ্রি অর্জন শেষে স্বামীসহ ফিরে আসেন আমেরিকার কানেক্টিকাতে। ১৯৭৮ সালে জন্ম নেয় প্রথম কন্যাসন্তান পিউ ফারুক। পিউ আমেরিকার একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। ১৯৮১ থেকে ’৮৬ পর্যন্ত কানিক্টিকাতে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিটে কম্পিউটার বিজ্ঞানী হিসেবে তার প্রথম কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। পরে নিউজার্সির ইবষষ ষধনং-এ তার পেশাগত জীবনের সুবর্ণ সময় পার করেন। ইতোমধ্যে ছোট মেয়ে প্রীতি ফারুকের জন্ম। প্রীতিও পরিসংখ্যানের ওপর স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে শিকাগোতে কর্মরত আছেন।

দৃঢ়চেতা এবং প্রত্যয়ী সামসুন্নাহার মনে করেন প্রত্যেক মানুষকে তার যোগ্যতা এবং অধিকারের মাপকাঠিতে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সদ্ব্যবহার করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। তার দুই সন্তানও সাবলীলভাবে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে বেগ পায়নি। স্বামী আমেরিকায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ ফারুক সব সময়ই তার পাশে থেকেছেন প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দিতে কখনও কার্পণ্য করেননি। অতিথি বৎসল সামসুন্নাহার প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে আমেরিকায় যে ভোজসভার আয়োজন করেন তা লোকমুখে প্রচলিত।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখায় নিউজার্সিতে সামসুন্নাহারের আতিথেয়তার কথা লিপিবদ্ধ আছে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন প্রবাসী বাঙালি হয়ে আজও রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান শুনতে ভালোবাসেন। দুই মেয়েকে বাঙালি সংস্কৃতির ধারায় বড় করার চেষ্টা করেছেন। পয়লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসের সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে তার কন্যাদের সম্পৃক্ততাও ছিল উল্লেখ করার মতো। সেইসব সাংস্কৃতিক উৎসবের মিলনমেলায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্বও তৈরি হয়। চিরায়ত বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পীদের কণ্ঠ এখনও তার কাছে চির-বিস্ময়। চেতনায়, আদর্শে অঙ্গ সৌষ্ঠবে আবহমান বাঙালি নারী বলতে যা বোঝায় সত্যিই তিনি তাই।