সন্দেহ

রোমেনা লেইস

আননোন নাম্বার থেকে কল এলে আজকাল ধরে না মিনু। স্ক্যামারদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। খুব জরুরি হলে ভয়েস মেইলে পরিচয়সহ সংক্ষেপে বক্তব্য রাখবে অথবা টেক্সট করবে। মিনু পরে কল ব্যাক করে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরছে মিনু। হাইওয়েতে ড্রাইভ করছে। এবার ছেলের কল। ব্লুটুথে হ্যালো বলল।
দীপন বলে, মামণি, তুমি কই?
ড্রাইভ করছি, বাবু। বাড়ি যাচ্ছি।
কল মি হোয়েন ইউ রিচ হোম, মা।
ইউ ক্যান টেল মি নাও ইফ এনিথিং ইম্পরটেন্ট।
না, মা।
ওকে, বাই।
বাসায় নেমে দরজা খুলে ব্যাগ রেখে কাউচে বসল। দীপনকে কল করল।
বাবু, কী খবর? সব ঠিকাছে?
মা, বাবা স্ট্রোক করেছে। বাবা হসপিটালে। আনকনশাস। শান্ত ধীর গলায় বলে দীপন।
থমকে যায় মিনু।
ওই দিনটা ছিল বুঝি গ্রীষ্ম ছুঁই-ছুঁই। হলুদ-বরণ রাধাচূড়ার ফুলের গাছ ছিল মলচত্বরে। এক সকালে ওইখানে গিয়ে দাঁড়াতেই কোথা থেকে যে দমকা হাওয়া এল। হলুদ-বরণ ফুলেরা সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ল। পেছন থেকে সে দেখে হেসে ফেলেছিল। ফিরে তাকাতেই চোখে চোখ। লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল মিনু। হলুদ-বরণ ফুল গায়ে মেখে হেঁটে গিয়েছিল দুজনে ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের পাশ দিয়ে শাহবাগের সিনোরিটায়।
কখনো ছায়ানটে গান করে হেঁটে হেঁটে রাগীব আহসানের ‘রেখায়নে’ বসে মিনুকে গাইতে হতো, তুমি কোন কাননের ফুল কোন গগনের তারা…
বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। দানা দানা শুভ্রতা রাতের নীরব শূন্যতাকে আলোকিত করে ছেয়ে আছে। মেহগনি কাঠের দরজাটা খুলতেই কেমন যেন ভিন্ন অনুভব ছেয়ে গেল হিম হিম শীতলতা। ছেলে দীপন এসে বাবার ডান পাশের শিয়রে দাঁড়িয়ে হাত রাখল হাতে। ছেলে এমআইটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করবে এ বছর। হসপিটালে আর অল্পক্ষণের মধ্যে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যাবে। মিনু ভাবলেশহীনভাবে পরিস্থিতি দ্বারা চালিত হচ্ছে। ৩০ বছরের যাপিত জীবনের রেশে এখনো কারও ভাবি, কারও চাচি, কারও মামি। যে যখন ফোন করছে, রোবটের মতো সবাইকে কুশল বা অবস্থা জানিয়ে দিচ্ছে। দুই দেশের ব্যাপার। অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে আসবে কেউ, তা সম্ভব নয়। স্ট্রোক করার পর তাই ছেলে দীপন খবর পেয়েছে। ছেলে মাকে জানিয়েছে। যদিও মা আইনগতভাবে বাবার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন। সেদিন বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে মানবিকতার খাতিরে হসপিটালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মিনু। মিনু যখন এসেছিল, তখনো হাসিব সেন্সলেস। বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। আইনগতভাবে ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে প্রায় দুই বছর। কিন্তু ত্রিশ বছরের সংসার আর দুটো ছেলেমেয়ের পিতা। তারও আগে একজীবনের দুরন্ত প্রেমিক; স্বামী। এত কিছু মুছে ফেলা কঠিন। যদি কারও প্রতি বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ জন্ম নেয়, তাহলে সম্পর্কের ফাটল ধরতে পারে। প্রতিদিন শুধু সন্দেহের বশে কত সম্পর্ক ভেঙে যায়, তার কোনো হিসাব নেই।
বাফেলো সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অনুষ্ঠান ছিল। বাসায় ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে আসতেই সামনে দাঁড়ায় আসিফ।
এত দেরি হলো যে?
আমার গানটা ছিল শেষে।
বাড়ি এলে কার সাথে?
রোহিত নামিয়ে দিয়ে গেল। এদিকটায় থাকে ও।
কিছু বোঝার আগেই গালে সজোরে থাপ্পড় পড়তেই হুঁশ হলো মিনুর। একছুটে ছেলেমেয়েরা যে রুমে সে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।
কী আশ্চর্য। আসিফ ওকে মারল? ও না এত ভালোবাসে! কী হিংস্র দেখাচ্ছিল ওকে। কেন? রোহিতকে নিয়ে কী সমস্যা? ও তো একটা বাচ্চাছেলে। অথচ শিল্পকলায় গান গেয়ে কত রাত আসিফ হোন্ডায় বাসায় নামিয়ে দিয়েছে। কত আগলে রাখত। ছেলে দীপন ঘুমে। মেয়ে দিতি জেগে ছিল। মাকে ওদের রুমে ঢুকতে দেখে চমকে তাকাল।
মা, বাবা হিট ইউ?
হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে মিনু। সেই শুরু, প্রতিদিন সন্দেহ করত। কখনো কলিগ, কখনো ছেলের ক্লাসমেট, কখনো গানের সহশিল্পীÑসবাইকে নিয়ে সন্দেহ। মেয়ে ডর্মে চলে গো হাইস্কুলের পর। ছেলে সব দেখে, বোঝে। ছোট, তাই চুপ করে থাকে। টুয়েলভ গ্রেডে ওঠার পর এক রাতে দেখে তুমুল ঝগড়া। পরদিন টেস্ট, তাই দরজা বন্ধ করে পড়ায় মনোযোগ দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু নাহ। সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কাচের বাসনকোসন ভাঙল যখন, আর থাকতে না পেরে বের হয়ে গিয়ে দেখে মার কপালে হাত। হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে।
টিস্যু দিয়ে রক্ত মুছে বাবাকে ধমক দিয়ে নিজের রুমে যেতে বলল। সেদিন হাতে হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে, ব্যাগে অল্প কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে সোজা কাছাকাছি এক হোটেলে গিয়ে ওঠে ওরা মা আর ছেলে। অল্প কিছু ক্যাশ আর ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড এই সম্বল। আর আঠারো বছরের ছেলে। সেই যে বের হয়ে এসেছিল ছেলেসহ আর ফেরেনি। চূড়ান্ত ছাড়াছাড়ি হয়েছিল।
ভাবি, ভাইয়া কি চোখ খুলেছে?
নারে নীপা।
ছোট বোন নীপা ফোনের ওপারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। মিনুর নিজের চোখেও কি ছাই জল এল।
জ্ঞান ফিরল। ছেলের কাছে বারবার মাফ চাইল। মিনুকেও বলল, ‘জানি, বললেও মাফ করবা না। তবু বলছি মাফ করে দিয়ো।’
বলেছিল সে, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি খুঁজে কী হয়, বলো তো!
আধো অন্ধকারে, ঝাঁপসা কুয়াশাজড়ানো সব স্মৃতি জড়ো করে আবার ছড়িয়ে দেওয়া। কোনো লাভ নেই। যে দিন গেছে তা তো গেছে। কী করলাম, কেন করলাম! কেন এমন হলো! এখন ভেবে কী আর হবে।
মৃত্যুপথযাত্রী প্রাক্তন স্বামীর শিয়রের কাছে বসে মোবাইলে তার বক্তব্য রেকর্ড করছে মিনু।
ওর স্বামী বলল, ‘মারে, আমাকে মাফ করে দিস, মা। আমি তোর যখন সাহায্য দরকার ছিল, তখন সাপোর্ট করতে পারিনি, মা। মাফ করিস তোর বাবাকে।’
এটুকু বলতেই হাঁপ ধরে বুকে। আসিফুল হক আসিফ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। মিনু রেকর্ড করা কথাটুকু শোনাল আসিফকে। তারপর মেয়ের নাম্বারে সেন্ড করে দিল। দিতি কোনো উত্তর দিল না। তবে ও যে মেসেজটা দেখেছে, আইফোন তা দেখাচ্ছিল। আসিফ বার কয়েক জিজ্ঞেস করল, দিতি উত্তর দিয়েছে কি না।
না, দেয়নি।
আনন্দধারা একদিন ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে ঘরের চালে, উঠোনে ছিটকে পড়বে খুশির জলচ্ছটা। একদিন অজস্র সম্পদ হবে, পৃথিবীর সব দামি দামি মন ভালো করা সরঞ্জাম কিনে ঘর ভরে ফেলবÑএমন ভাবনা ভাবতে ভাবতে বছর-যুগ পার করতে চাইলে জুটবে কেবল বয়সের ভার। মিনু ভাবে, সেসবে কী কাজ? আজকের অমূল্য মুহূর্তগুলোকে ভালো লাগার হালকা ঝুলিতে ভরে হাসির ফোয়ারা তুলতে তুলতেই বেরিয়ে পড়ি। কোমরে যতটুকু জোর এখনো আছে বাকি, তাতেই দুলে উঠি ছন্দে ছন্দে। এক নৈশভোজে যাওয়ার প্রাক্কালে নরম সাধারণ একটি শাড়ি পরে তৈরি হয়ে গেল, আসিফও পরে নিয়েছে আকাশি রঙের শার্ট। তারপর বাসার বৈঠকখানার কোণে দাঁড়িয়ে দন্ত বিকশিত করা ছবি তুলে নিল মুঠোফোনে। কিন্তু আচমকাই আসিফ ঘোষণা করল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি পোস্ট করবে না। বুঝলে? মিনু থমকে যায়। দুজনের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
আসিফ আনমনে বলে, পাতাঝরা রাস্তায় পাতা মাড়ানোর শব্দ শুনতে শুনতে একবার সাধ হয়েছিল অবশ্য ফিরে তাকাতে। কতবার ভেবেছি ডাকি, ফিরে আসতেও পারে। কিন্তু মনের অহমিকা আমাকে যে ডাকতে দিল না।
সন্দেহপ্রবণ মানুষের আয়ু কম। সুইডেনের স্টকহোম ইউনিভার্সিটির একদল শিক্ষক ২৪ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা করে এ তথ্য দিয়েছেন। খবর ডেইলি মেইলের। এত সন্দেহপ্রবণ মানুষ কেমন করে হয়। সুন্দর জীবনযাপন ও দীর্ঘায়ুর জন্য সন্দেহপ্রবণ মনোভাব দূর করতে হবে এবং মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে। অথচ আসিফ প্রচণ্ড সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত। সকালে কাজে গেলে সারা দিন চিন্তা করত মিনু কার সঙ্গে কী করছে।
অনেকগুলো গল্পকথা জমা ছিল রাতদুপুরে। দুপুর থেকে শেষ বিকেল অবধি অফিস শেষে ক্লান্ত মিনু হসপিটালের করিডোর ধরে ধীর লয়ে হেঁটে এসে বসে। ভাবে, আমরা জানতাম না আমাদের কত কথা হারিয়ে গেছে কালের মহাস্রোতে, একটু একটু করে তুলে এনেছি স্মৃতি থেকে। স্বপ্ন, স্মৃতি ও কল্পনার মাঝেই আমাদের বেঁচে থাকা। সুন্দর একেকটি দিন চলে গেল শুধু অকারণে। মানুষের জীবন যেন ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দুর মতোই ঠুনকো। একটু হালকা বাতাসের দোলায় গড়িয়ে পড়ে। একটি নিঃশ্বাসের এপারে মানবজীবন, ওপারে নিথর শরীর। অথচ কিছু মানুষের ইগো এত শক্তিশালী যে তার থেকে বের হয়ে আসতে পারে না মানুষ। গির্জায় ঘণ্টা বেজে চলে। সন্ধ্যার এই সময়টা কেন যেন খুব বিষাদ করুণ মনে হয়। এ সময় ডাক্তার জানালেন, সব শেষ।
টেলিভিশনের কোন চ্যানেলটা খোলা রাখা, সেটা সঠিক মনে নেই। তবে কেমন করুণ কিন্তু ভরাট স্বরে কে যেন গেয়ে চলেছে চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রেÑআসলেই সামনে বড্ড অন্ধকার দেখছে মিনু। আলোগুলো নিভু নিভু হয়ে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে বৈকি।