মোস্তফা কামাল : বোঝা লাগে না, জানাও লাগে না। না শুনলেও চলে। যে কোনো বিষয়ে বিশারদ হয়ে যাওয়া বঙ্গদেশে এখনকার অন্যতম সহজ কাজ। আগুন-পানি, শীত-গরম, করোনা-কলেরা থেকে লঞ্চ-বাস, ট্রেন-বিমান দুর্ঘটনা- সব বিষয়ে বিশারদে ভরপুর
বাংলাদেশ। কোন বিষয়ে জানেন না তারা?
তারা জানেন না- এমন বিষয় তালাশ করে পাওয়া বড় কঠিন। তাই তালাশ না করে তাদের সব বিষয়ে ‘বিশেষজ্ঞ’ ধরে নেয় গণমাধ্যমগুলো। টেলিভিশনে টক শো, পত্রিকায় কলাম-পোস্ট- সব জায়গায় বিশিষ্টজন তারা। গত ক’দিন তারা আগুন বিশেষজ্ঞ। তারাই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। কেন এতো গরম পড়ছে, কেন বৃষ্টি নামছে না?- সব বলে দিচ্ছেন গড়গড় করে। তাহলে কূটনৈতিক বিশারদ-বিশ্লেষক হতেই কী সমস্যা?
না, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কী চমৎকার করে বলে দিচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মনোজগতের কথা! বাইডেনকেও ছাড়ছেন না। আর বঙ্গবন্ধু তো ব্যাপারই না। তার বন্দনায় যা-তা বলে দেয়া, আবার তার নানান ভুল বের করার কতো মহাওস্তাদ এই বঙ্গে! এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিও বুঝিয়ে দিচ্ছেন কী নিমিষে? সেখানে বঙ্গবাজারের আগুন কোনো বিষয়? বঙ্গবাজারের আগুনে মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হবার যন্ত্রণা না বুঝলেও কিছু যায়-আসে না তাদের। ট্রমা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে কতোটা সময় লাগতে পারে, তা না ভাবলেও চলে। হিজরারা তাদের কতো দিলো, সাকিবের দেয়া টাকায় কী হবে- এমন অবজেক্টকে সাবজেক্ট করে ফেলা হচ্ছে কথামালায়। জীবনে কখনও বঙ্গবাজারে যাননি বা বঙ্গবাজারের ব্যবসা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা না থাকলেও বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। কেউ অগ্রাহ্য করছেন তাদের?
বঙ্গবাজার কেন্দ্রিক ব্যবসা হাজার-কোটি টাকার উপরে হবে, তার মানে কি বঙ্গবাজারের সবাই কোটি টাকার ব্যবসায়ী। বঙ্গবাজারে এককভাবে কোটি টাকা পূঁজি খাটানোর মত ব্যবসায়ী কতো জন? আর তারা সবাই কোটিপতি হলেই কি তাদের সম্পদে আগুন দিতে হবে? বঙ্গবাজারে দোকানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি নয়। এই তিন হাজার দোকানের মধ্যে অনেক দোকানের মালিক ছিলেন একাধিক জন। একজন দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন, তিনি আবার এক বা দু’জনকে সাবলেটও দিয়েছেন। একাধিক আইটেমের বেশিরভাগ দোকানই ছিল এমন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অনেকেরই মার্কেটের বাইরে গোডাউন ছিল না। ছোট-মাঝারি দোকাদারদের বিনিয়োগকৃত পূঁজির পরিমাণ নূন্যতম দুই লাখ টাকা হতে ১৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। ঈদের সময় বিনিয়োগ আরো বাড়ত। ওই বাড়তি কি তাদের ব্যাংক দেয়, বা দিতো?
মোটেই না। এ মানের ব্যবসায়ীদের ব্যাংক পাত্তা দেয় না। এ পূঁজির যোগান দিতো এনজিও ঋণ, সমিতির ঋণ এবং ব্যক্তিগত ঋণ। তাদের সবচে বড় পূঁজি ছিল কমিটমেন্ট। এই কমিটমেন্টের সুবাদে তারা বিভিন্ন কারখানা হতে বাকিতে মাল কেনে। অথবা মৌসুমের শুরুতে কারখানা মালিকদের হাতে ২-৩ লাখ টাকা দিয়ে একটা রিলেশন গড়ে। কিছু লেনদেন করে সারা বছর বাকিতে মাল নেয়, ঈদ-চাঁন্দে তা শোধ করে বিশ্বস্ততা পোক্ত করে। বেশি লাভের জন্য কিছু কারখানা মালিকও বিনিয়োগ করতেন, ক্রেডিটে পণ্য দিতেন। এসব জানেন বিশেষজ্ঞরা?
গণমাধ্যমেও ঘুরেফিরে এসেছে কেবল বড়রা। আসল ক্ষতিগ্রস্তরা আড়ালেই পড়ে গেল। বঙ্গবাজারে যেন কোটি টাকা বিনিয়োগের নিচে কোন ব্যবসায়ী নেই। যেসব বড় ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট পূঁজি ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বঙ্গবাজার থেকে বিতাড়িত করতে চান, বেছে বেছে তাদের স্বার্থে কি ঝাঁপিয়ে না পড়লেই নয়? বঙ্গবাজারে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ দোকানদারদের কেন্দ্র করে আরো কত মানুষ ক্ষতিতে পড়েছে, সেই হিসাব কখনো জানা যাবে? তাদের বেশিরভাগই নতুন করে আর ব্যবসা পাততে পারবেন না। বঙ্গবাজার হয়তো আধুনিক মার্কেট হবে, আবার জমজমাট হবে, কিন্তু সর্বস্ব হারানো ব্যবসায়ীদের হাহাকার পৌঁছাবে সেখানে?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন, ঢাকা।