নিজস্ব প্রতিনিধি : সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রত্যাশা দেশের সাধারণ মানুষ ও বিদেশিরা করলেও আওয়ামী লীগের চিন্তা ভিন্ন। তারা আবারো চাইছে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনী ময়দান পার হতে। তবে এবার ৫ জানুয়ারির মতো না করে ভিন্ন ছকে নির্বাচন করতে চাচ্ছে দলটি। তারা চেষ্টা করছে বিএনপিকে বাদ দিয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিক অধিকাংশ দল এবং অন্যান্য দল ও জোটের সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন সম্পন্ন করা। শুধু সর্বাধিক দলই নয়, গুরুত্ব দেওয়া হবে বিপুলসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণের বিষয়টিও, যাতে বহির্বিশ্বকে বোঝানো সম্ভব হয় অধিকাংশ দল ও অধিকসংখ্যক ভোটার এই নির্বাচনে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ লক্ষ্যে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোট প্রদত্ত হয়েছে, এমনটা দেখানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র এবং দলের একজন অন্যতম নীতিনির্ধারক জানান, তারা বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ চান। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, চীনসহ বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহী সব দেশই সব দল ও বিপুলসংখ্যক ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন কামনা করেন। বিভিন্নভাবে সরকারের কাছে তাদের এ মনোভাব জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো দল নির্বাচনে না এলে তাদের ছাড়া নির্বাচন করা যাবে না এবং সে নির্বাচন তাদের গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এমন কোনো কঠোর মনোভাব তারা এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঠিকানাকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা অবশ্যই বিএনপির অংশগ্রহণ চাই। বিএনপি একটি বড় দল। এদের বাইরে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার চিন্তা করি না। কিন্তু আমরা তো তাদের হাতে-পায়ে ধরে নির্বাচনে আনতে পারি না। তাদের প্রয়োজনেই তাদেরকে নির্বাচনে আসতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করাসহ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় সবাই করবে। নির্বাচন বর্জন করে নির্বাচন ও সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তাদের যাবতীয় কৌশল ও তৎপরতা ব্যর্থ হবে।
বিএনপির একাধিক নেতৃস্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া সমার্থক বলে তারা মনে করেন। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শতাধিক কেন্দ্র দখল করে ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতির অসংখ্য প্রমাণ জাতীয় ও বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত, প্রচারিত হয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবে সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করেছেন। এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ভোট হবে না, সাধারণ মানুষের কাছেও তা স্পষ্ট। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় দলীয় কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতির নির্বাচন প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। বিএনপির অভিযোগ, বিএনপির নেতারা আরো আশঙ্কা করছেন, ৫ জানুয়ারির মতো উলঙ্গভাবে না করে নানা কৌশল ও ইঞ্জিনিয়ারিং মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ও বাইরের পূর্বনির্ধারিতদের বিজয়ী করা হবে। খুলনার অভিজ্ঞতার পরও বিএনপি গাজীপুর ও অপর তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। যদিও এর বিপক্ষে দলের মধ্যেই ভিন্নমত রয়েছে। মানুষের সামনে সরকারের মুখোশ অধিকতর উন্মোচন করা এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সরিয়ে দেওয়া, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবিতে জনমত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে বিএনপি কৌশলগতভাবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানা যায়। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি নেবে কি না তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এখনো। খালেদা জিয়ার জামিন ও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় কি না এবং তারেক রহমানের মামলা নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত দেখেই তারা সিদ্ধান্তে আসবেন। রাজনৈতিক মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে সরকার এগুলো ব্যবহার করছে। উদ্দেশ্য খালেদাবিহীন বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া জামিন পেলেও মুক্তি পাচ্ছেন না। চারটি নাশকতার মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা আগামী দুই মাসের মধ্যে নিষ্পন্ন হয়ে যাবে। এই মামলায় কমপক্ষে পাঁচ বছরের দ- দেওয়ার মতো যুক্তি, প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়েছে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান। তাদের দৃঢ়বিশ্বাস, এ মামলায় খালেদা জিয়ার দ- হয়ে যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো মামলায় জামিন পেলেও তিনি নির্বাচনের অযোগ্যই থেকে যাচ্ছেন।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উল্লেখযোগ্য অংশকে নিয়ে খালেদার সম্মতিতেই ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারি পরিকল্পনা সফল হওয়ার ব্যাপারে সরকারি মহল আশাবাদী। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে এবং সে প্রক্রিয়া গুছিয়ে আনার কাজ প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে বলে সরকারি মহল থেকে জানা যায়। বিকল্পধারার সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিএনপির ইফতার মাহফিলের বক্তব্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতার নির্বাচনী পরিকল্পনারই অংশ বলে তারা মনে করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ড. কর্নেল অলি আহমদের এলডিপি, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোটসহ ইসলামী দলগুলোকে নির্বাচনে আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
বিএনপি খালেদাবিহীন নির্বাচনে অংশ নিলে সমঝোতার ভিত্তিতে ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো দলগতভাবে নির্বাচন করবে। তবে শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া-তারেক রহমান নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত দিলে তারা ১৪ দলগতভাবেই নির্বাচন করবে। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে গভীর সমঝোতা রয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে যদি না-ও আসে, অপরাপর দলগুলোকে নির্বাচনী মাঠে নামিয়ে ব্যাপকসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে নির্বাচন নিশ্চিত করার বিকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাবে সরকার।
সরকারের সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বড় রকমের কোনো বাধার সম্মুখীন হতে না হওয়া। নিকট প্রতিবেশী ভারতের দিক থেকে সরকার সুস্পষ্ট সমর্থন পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এখন আর আগের মতো বিরোধী মনোভাব নেই। ভারতের মধ্যস্থতায় তারা শেখ হাসিনা ও তার সরকারের প্রতি নমনীয়তার নীতি নিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরকারবিরোধী অবস্থানে নেই। চীন একান্তভাবেই শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে এদের সবাই এখানে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, বিপুলসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে নির্বাচন চায়। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া কী করে তা নিশ্চিত করবে সরকার। বিএনপি না এলে সেই নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মহলের গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, এমন কোনো আভাস-ইঙ্গিতও সরকার পায়নি। মূলত যে কারণে সরকারদলীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন ঠেকে থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন। এটা শুধু বিএনপিকে হুমকি দেওয়া নয়, সরকার প্রকৃতই সে রকম প্রস্তুতি নিচ্ছে।