সমকালীন: ট্রাম্প-উন বৈঠক

শিতাংশু গুহ

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসকালীন নিউইয়র্ক সিটির মেয়র রুডি জুলিয়ানী বলেছেন, উত্তর কোরীয় প্রেসিডেন্ট কিম জং উন একরকম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে পায়ে ধরে ‘ট্রাম্প-উন’ নির্ধারিত ১২ই জুন বৈঠক পুনঃ নির্ধারণে সক্ষম হয়েছেন। একদা ভীষণ জনপ্রিয় রুডি জুলিয়ানী সচরাচর অপ্রিয় সত্য ভাষণের জন্যে প্রায়শ: সমালোচিত হন। বর্তমানে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘রাশিয়া কানেকশন’ বিষয়ক এটর্নী। বৈঠক নিয়ে তার বক্তব্য সঠিক। ট্রাম্প-উন নির্ধারিত বৈঠক মঙ্গলবার ১২ই জুন ২০১৮ সকাল ৯টায় সিঙ্গাপুরের সেনসোটা দ্বীপের কাপেলা হোটেলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পূর্বাহ্নে, মে মাসের শেষের দিকে অকস্মাৎ ট্রাম্প বৈঠক বাতিল করে দেন। সে সময় কোরীয় উপদ্বীপে মার্কিন-দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ সামরিক মহড়া চলছিলো, প্রতিবাদে পিয়ং-ইয়ং উল্টাপাল্টা কথা বলে এবং উন যথারীতি হুমকি দেন। এ প্রেক্ষিতে ট্রাম্প শীর্ষ বৈঠক বাতিল করেন। এটি ছিলো একটি কূটনৈতিক চাল এবং এই চালে উন ধরা দিতে বাধ্য হন। জুলিয়ানী তাই বলেছেন, ‘আমরা সেটাই চেয়েছিলাম’। এখন অবশ্য ট্রাম্প উত্তর কোরিয়া ও উনের বেশ প্রশংসা করছেন। ভাবটা এই যে, ‘ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যাও, যা চাও তাই পাবে-’।
কিম জং উন নিশ্চিয়তা চেয়েছেন যাতে তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারেন। আমেরিকা তাকে সেই নিশ্চিয়তা দিয়েছে বা দেবে। উন চেয়েছেন তার দেশ যাতে বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত না হয় ? আমেরিকা সেই নিশ্চিয়তা দেবে। মুখ্যত: আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করবে কে? আর এই দু দেশ যখন গ্যারান্টার তখন ভয় কি? এটি অনেকটা ‘শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা’ দেয়ার মত? তবে আমেরিকা সত্যিকার অর্থেই চাইছে উত্তর কোরিয়াকে বাগে আনতে, এতে সবার লাভ।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বর্তমান সপ্তাহে দেখা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে। তাদের আলোচনায় ট্রাম্প-উন বৈঠক গুরুত্ব পেয়েছে। উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে জাপানের মাথাব্যথা আছে। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক নিরস্ত্রিকরণে সম্মত হলে জাপান লাভবান হবে বা ভয় কমবে? মুখ্যত: উত্তর কোরিয়া শান্ত হলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। আমেরিকার প্রত্যক্ষ কোন লাভ নেই, বিশ্বমোড়লের লাভ বৈশ্বিক।
যুক্তরাষ্ট্র আসলে উত্তর কোরিয়ার কাছে কি চায়? মুখ্যত: পারমাণবিক নিরস্ত্রিকরণ। স্মর্তব্য যে, উন এ বছরের শুরুতে ঘোষণা করেছিলেন যে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন ভূখন্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। আমেরিকার জন্যে এটি খুব সুখের ছিলো না? যুক্তরাষ্ট্র চায়না আর কোন দেশ নতুন করে পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জন করুক। বিশেষত: মার্কিন ভূখন্ডে আঘাত হানার ক্ষমতা কাউকে অর্জন করতে দেবে না। তাই আলোচনার টেবিলে পারমাণবিক নিরস্ত্রিকরণ হবে মুখ্য। তদুপরি উত্তর কোরিয়ার একমাত্র বন্ধু চীনের বন্ধুত্বে যদি ভাগ বসানো যায় তো মন্দ কি?
ট্রাম্প-উন বৈঠকটি অনেকটা বড়লোকের বাড়িতে গরীবের মহাসমাদরে নিমন্ত্রণের মত। প্রশ্ন উঠতেই পারে, উন হঠাৎ করে ‘নরম’ হলেন কেন? জুলফিকার আলী ভূট্টো একবার বলেছিলেন, ‘ঘাস খেয়ে থাকবো, তবু পরমাণু বোমা বানাবো’। উন তো তাই করতে পারতেন? সম্ভবত: এখানেই উত্তর কোরিয়ার সাথে পাকিস্তানের তফাৎ। একই কারণে উত্তর কোরিয়াকে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু ইরানকে নয়।
এটি জুন মাস। ১৯৫০ সালের ২৫শে জুন উত্তর কোরিয়া হঠাৎ দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে এবং দ্রুত রাজধানী সিউলের দিকে এগিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের ম্যান্ডেট নিয়ে সসৈন্যে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। চীন তখন এগিয়ে আসে। ১৯৫৩ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধ থামে কিন্তু দুই কোরিয়ার বিভক্তি স্থায়ী রূপ নেয়। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া তীব্র শত্রুতা থাকলেও বড় ধরনের তেমন কোন যুদ্ধ ছিলোনা। এর চেয়ে বরং ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক হাজারগুণ খারাপ ছিলো? সে সব সমস্যা মিটমাট হয়েছে, উত্তর কোরিয়ার সাথে হবেনা কেন?
সিএনএন জানাচ্ছে, প্রথম দিন সবকিছু ভালোভাবে চললে ট্রাম্প-উন বৈঠক দ্বিতীয় দিনে অব্যাহত থাকতে পারে। বৈঠকে ট্রাম্প চাইবেন সম্পূর্ণ দৃশ্যমান পারমাণবিক নিরস্ত্রিকরণ। উন কতটা ছাড় দেবেন তা কেউ নিশ্চিত নন। তবে বিশ্বমিডিয়া জানাচ্ছে, পরিবেশ ‘অনুকূল’। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আশাবাদী। তবে সমস্যা একদিনে মিটে যাবেনা, আলোচনা চলবে। ট্রাম্প আরো বলেছেন, ‘আমি প্রস্তুত। তবে আমি মনে করিনা যে, এই বৈঠকের জন্যে তেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে; কারণ এটি মূলত: ‘এটিটিউড’ প্রশ্ন’। পরিবেশ সুস্থ রাখতে ট্রাম্প এও বলেছেন যে, তিনি উনকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন।
উত্তর কোরীয় প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের বাপের ভাগ্যি, যদি সেই নিমন্ত্রণ পান। উন ইতোমধ্যে চীন সফর করেছেন। রাশিয়া যাওয়ার সম্ভবনা আছে বছরের শেষে। ওয়াশিংটন এলে এটি হবে আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এমনিতে ট্রাম্প-উন বৈঠক গত সাত দশকে এক বিরাট ইতিহাস। কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোরিয়া অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এতটা অগ্রগতি অর্জন করেননি। ট্রাম্প ও তার বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পিও এই অচলায়তন ভাঙ্গছেন?
কোরীয়া এক্সপোজ মিডিয়া জানাচ্ছে, বিগত বছরে যথেষ্ট পারমাণবিক হুমকি-ধামকির পর বছর শেষে নতুন বছরের শুরুর ভাষণে কিম জং উন বলেছিলেন, ‘আমার জনগণের উন্নয়নের বিষয়টি আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি; কিন্তু আমার সামর্থ নেই এই স্বপ্ন পূরণের। তাই গত বছরে আমি বারবার অনুতপ্ত হয়েছি, অপরাধভোগে ভুগেছি’। প্রশ্ন হলো, একজন স্বৈরাচারীর বোধোদয়, আসলেই কি সম্ভব? এই বক্তব্য যদি সত্য হয়, তবে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তির বাতাস দ্রুত বইতে শুরু করবে।

কলামিস্ট, নিউইয়র্ক, ৯জুন ২০১৮।