শিতাংশু গুহ
শিশু দেবদত্ত (৯)’র নিস্প্রাণ, নিষ্প্রাপ চেহারার ছবিটি দেখে বেশ খারাপ লেগেছে। অপহরণের ১৬দিনের মাথায় (২৫ জুন ২০১৮) লাশ হয়ে ফিরে এসেছে দেবদত্ত। হাত-পা বাঁধা বস্তাবন্দী লাশ। নির্মম, নিষ্ঠুর ঘটনা। ছোট্ট শিশু। হয়তো তাকে জীবন্ত বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। হয়তো খুন করে বস্তায় ভরে জলে ফেলে দেয়া হয়েছে। চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটি একবার ভাবুন! শিউরে উঠবেন।
শিশুদের বলা হয় ‘এঞ্জেল’। এমন একটি কোমল শিশুকে যারা নির্মমভাবে খুন করতে পারে, ওরা কি মানুষ? শিশু দেবদত্তের হত্যাকান্ড যতটা পাশবিক, ঠিক ততটাই হৃদয়বিদারক তার মায়ের আহাজারি। এদৃশ্য দেখা যায়না, ছবি দেখেই হৃদয় ভেঙে যায়? গন্তানহারা মায়ের বুকফাঁটা আর্তনাদ দেখে বিবেক অবরুদ্ধ হয় বটে।
ঘটনা কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের। দেবোত্তর সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন দেবদত্তের বাবা। প্রতিশোধ নিতে দেবদত্ত অপহরণ। মুক্তিপণ চাওয়া। না পেয়ে শিশু খুন। তারপর পাওয়া যায় বস্তাবন্দী হাতবাঁধা লাশ। কতটা কষ্ট পেয়ে মরেছে দেবদত্ত কে জানে? তবে এ মৃত্যু কাম্য নয়?
দেবদত্ত খুনের দায়ে অভিযুক্ত দু’জন পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে। ক্রসফায়ার আইনসম্মত নয়, তবু কখনো-সখনো মনে হয় এছাড়া উপায় কি? দেবদত্ত মরে বেঁচেছে। এ দেশ দেবদত্তের নয়। জন্মই তার আজন্ম পাপ। দেবদত্ত শিশু নয়, ও হিন্দু। হিন্দুর সম্পত্তি, হিন্দুর কন্যা তো ‘গনিমতের মাল’, হিন্দুর শিশুপুত্রও কি তাই হয়ে গেলো?
যে কেউ বলতে পারেন, এটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়! ভালো কথা, দেবদত্ত হিন্দু না হলে কি এঘটনা ঘটতো? কেউ কি মসজিদের সম্পত্তি জবর-দখল করতে যায়? হিন্দুর জমিও আজকাল ‘গনিমতের মাল’ হয়ে গেছে, তাই সবাই দখল করে? রাগিব আলী, এমপি দবিরুদ্দিন, কে না? এনিয়ে অত্যাচার, হত্যার ঘটনা খুব কম নয়?
কোন কোন মৃত্যু বিবেককে ধাক্কা দেয়, দেবদত্তের মৃত্যু প্রশাসনকে ধাক্কা দিয়েছে বলেই দু’জন মরেছে। অবধারিত সত্য যে, দেবদত্তকে জীবিত উদ্ধারে প্রশাসনের গাফিলতি ছিল, ছিল কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনোভাব, ‘গরিব হিন্দুর পোলা’ উদ্ধারে পুলিশের সময় কই? হিন্দুর সম্পত্তি দখল বাংলাদেশে মহামারী আকার ধারণ করেছে, এই ঘটনা এর জাজ্জ্বল্য প্রমাণ।
প্রশ্ন হলো, শিশু দেবদত্তের হাতবাঁধা বস্তাবন্দী লাশ কি আপনার বিবেককে নাড়া দিয়েছে? আপনি কি কেঁদেছেন? প্রতিবাদ করেছেন? দেবদত্তের লাশ দেখে অনেকের মনে সিরীয় শরণার্থী শিশু ‘আইলান’র মৃতদেহ’র কথা মনে পড়েছে। আইলানের মৃতদেহ নিয়ে বিশ্বব্যাপী হৈচৈ হয়েছিলো, দেবদত্তের মৃতদেহ নিয়ে কিচ্ছু হয়নি, হবার কথাও নয়?
আইলান ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সিরিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় সমুদ্রে পরে নিহত হয়। দেবদত্ত মানবতা বিরোধী অপরাধের শিকার। আইলানকে প্রকৃতি মেরেছে, বিশ্ববাসী তাতে কেঁদেছে। দেবদত্তকে মানুষ মেরেছে, বাংলাদেশের মানুষ কাঁদলো কই? যারা ভাবছেন এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা এসবের সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোন সম্পর্ক নেই, তাদের জন্যে একটি গল্প বলছি।
গল্পটি পলাশ ভট্টাচার্য্য থেকে ধার করা: একব্যক্তি একটি গাধা নিয়ে মানুষভর্তি এক নৌকায় ওঠে। নৌকা ছাড়লে জল ও বাতাসের তালে তালে সেটি দুলতে থাকে। এতে গাধা ভয় পেয়ে লাফালাফি শুরু করে। যাত্রীরা এতে ভয় পেয়ে যায়, নৌকা ডুববে না-তো? গাধার মালিক চেষ্টা করেও গাধাকে থামাতে পারেনা। তখন এক বৃদ্ধ যাত্রী বললেন, তিনি গাধাকে শান্ত করতে পারবেন! কি আর করা, তাকে সুযোগ দেয়া হলো। বৃদ্ধ আরো দু’একজন যাত্রীর সহায়তায় গাধাকে পানিতে ফেলে দেন। গাধা বাঁচার তাগিদে সাঁতরাতে শুরু করে এবং একসময় নৌকার দড়িটি কামড়ে ধরে। বৃদ্ধের ইঙ্গিতে সবাই গাধাকে আবার নৌকায় উঠায় এবং এবার গাধা চুপচাপ এককোনায় বসে থাকে।
যাত্রীরা জানতে চাইলো, বিষয়টা আসলে কি? বৃদ্ধ বললেন, জলে ফেলে দিলে গাধা সত্যিকার বিপদ টের পায়। নৌকা যে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ চাই। নিজের এবং সহযাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গাধা বুঝতে সক্ষম হয়? যে কারণে গাধা চুপ হয়ে যায়? বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থাটা ঐ পানিতে ভাসা গাধার মত; সংখ্যাগুরু পানিতে না পড়লে এই যাতনা বুঝবেন কি করে? গাধার ক্ষেত্রে একজন সহৃদয় ও বিচক্ষণ বৃদ্ধ যাত্রী এবং নৌকার দড়ি ছিলো। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে দড়ি বা হৃদয়বান বৃদ্ধ আজকাল পাওয়া বেশ মুশকিল!
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
০২ জুলাই ২০১৮। নিউইয়র্ক।