শিতাংশু গুহ
১৯৬৪ সালের দাঙ্গার কথা বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষতঃ হিন্দুদের ভোলার কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের নির্যাতন তো আরো ভয়াবহ। এ দুটো ঘটনায় টার্গেট ছিলো হিন্দুরা। ১৯৬৪ সালে শুধুই হিন্দুরা, আর ১৯৭১ সালে হিন্দু ও আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে হিন্দুশূন্য করতে হিন্দুদের টার্গেট করে। তারা জানতো হিন্দুরা অখন্ড পাকিস্তানের শত্রু। এখনো বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এবং হিন্দুরা পাকিস্তানকে পছন্দ করেনা। পছন্দ করার কোন কারণও নেই?
একটি গল্প বলি, গল্পটি এক পাকিস্তানী ও ভারতীয়ের মধ্যেকার, তবে দৃষ্টিকোণ অভিন্ন। ঈশ্বর এক পাকিস্তানী ও এক ভারতীয়কে তাদের দেশ নিয়ে একটি করে ‘বর’ দিতে চাইলেন। প্রথমে পাকিস্তানী বললেন, ‘ভারত আমাদের বড়ই জ্বালাতন করে, আপনি পাকিস্তানের চতুর্দিকে উঁচু একটি দেয়াল করে দেন যাতে ভারত আর কিছুতেই আমাদের জ্বালাতন করতে না পারে’। ঈশ্বর বললেন, ‘তথাস্তু’। এবার ভারতীয় বললেন, ‘হুজুর, বর চাওয়ার আগে আমার একটি প্রশ্ন আছে? ঈশ্বর বললেন, ‘বলো’। ভারতীয় বললেন,, আপনি পাকিস্তানের চারদিকে যে দেয়াল বানাবেন, এর ভেতর থেকে কি কেউ বেরুতে পারবে, বা বাইরে থেকে কেউ ভেতরে ঢুকতে পাবরে? ঈশ্বর বললেন, না। ভারতীয় তখন বললেন, ‘তাহলে আমি বর চাই হুজুর, আপনি ঐ দেয়ালটি পানি দিয়ে ভর্তি করে দিন’।
গল্প তো গল্পই, তবে বিষয়টি হয়তো এ রকমই। বাংলাদেশে কিছু পাকিস্তানপন্থী ছাড়া আপামর মানুষের ধারণাটা কমবেশি অপছন্দের। পাকিস্তান বারবার হিন্দুকে টার্গেট করে বিরাট ভুল করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধকালে যদি পাকিস্তান হিন্দুদের টার্গেট না করতো, এক কোটি শরণার্থী, ভারতে না যেতো, তাহলে বিশ্ব জনমত ঐভাবে গড়ে উঠতো কি-না, শ্রীমতি গান্ধী ততটা সুবিধা করতে পারতেন কি-না, বা এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কি-না তা গবেষণার বিষয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, হিন্দুদের টার্গেট করে পাকিস্তান ভুল করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দুরা এখনো সব ধরনের অত্যাচারের ‘সফট টার্গেট’, বাংলাদেশ কি একই ভুল করছে?
ক’দিন আগে এক লেখায় ‘হিন্দুশূন্য বাংলাদেশের একটি চিত্র দিয়েছিলাম। এতে অনেকে ‘গোস্বা’ হয়েছেন। ওতে বলা হয়েছিলো, বাংলাদেশের হিন্দুরা না থাকলে দেশটি কি পাকিস্তানের মত দেখতে হবে না আফগানিস্তান বা কাশ্মীরের মত? ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে ৩৩% সংখ্যালঘু ছিলো, এখন ১%। এতে কিন্তু পাকিস্তান ‘স্বর্গরাজ্য’ হয়ে যায়নি, বরং উল্টোটি হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দুরা না থাকলে দেশটির চেহারা সিঙ্গাপুরের মত হবেনা, আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মত হবার আশঙ্কাই বেশি। কাজেই হিন্দুরা কেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার, এতে আখেরে সবার লাভ, দেশের লাভ। সবার সাথে ‘শান্তিপূর্ণ’ সহাবস্থান ‘শান্তির’ পূর্বশর্ত।
স্বাধীনতা যুদ্ধে হিন্দুদের অপরিসীম ত্যাগের কোন তুলনা হয়না। এক কোটি শরণার্থী যাদের বেশির ভাগ হিন্দু, তারা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে এসেছিলো। এসেছিলো থাকতে। ভাবেনি আবার পালাতে হবে? কেন থাকতে পারছে না? কেন পালাতে হচ্ছে? গৎবাঁধা সাফাই গেয়ে লাভ নেই, সমস্যার গভীরে ঢুকতে হবে? ভারতের সংখ্যালঘুর দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে লাভ নেই! ভারতের মত পরিস্থিতি যদি বাংলাদেশে থাকতো তাহলে একজন হিন্দুও দেশত্যাগ করতো না?
হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে সর্বদা সমর্থন দিয়েছে। এজন্যে হিন্দুদের বলা হয় ‘ভোটব্যাংক’। প্রতিদানে কি পেয়েছে সেটি আওয়ামী লীগ কখনো ভাবেনি। এখন সম্ভবতঃ ভাবার সময় এসেছে। আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই এবং দেখতে চেষ্টা করি গত ৪৭ বছরে কোন সরকার সংখ্যালঘুদের জন্যে কি করেছে, তাহলে হতাশ হতে হবে বৈকি! কথার ফুলঝুরি ছাড়া হিন্দুদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। ৫২ বছরের মাথায় শত্রু সম্পত্তি আইনের কিছুটা সুরাহা হলেও লাভের কোন সম্ভবনা নেই? অথচ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে হিন্দুরা যদি ১০০% ভোট আওয়ামী লীগকে না দিতো, তাহলে বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতেন না, দেশ স্বাধীন হতো কিনা বলা শক্ত। এ জন্যেই হয়তো সদ্য ঐক্য পরিষদের মহাসম্মেলনে ড: আনিসুজ্জামান বলেছেন, সংখ্যালঘুর প্রত্যাশা পূরণে রাষ্ট্র ব্যর্থ, রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থার কারণে তারা দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন।
দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে খুব বেশি মানুষ সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে কথা বলেননা, বরং ভারতকে টেনে এনে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করেন। সদ্য এক অনুষ্ঠানে এক ভদ্রলোক আমায় বলেন, আচ্ছা, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে আওয়ামী লীগ আর দোষ দেয় বিএনপির, এর কারণ কি? তাকে বললাম, আপনি তাহলে মানছেন, দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে যারাই ক্ষমতায় থেকেছে তারাই সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার করেছে। এতে কোটারী স্বার্থ নিহিত। ক্ষমতায় ছিলো এমন সকল দল, তা ছোট বা বড়, যাই হোক না কেন, সাম্প্রদায়িক কার্ডটি সবাই খেলেছেন।
জিয়াউর রহমান সাম্প্রদায়িক কার্ডটি খেলেছেন এবং মরেছেন। এরশাদ ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ করেছেন। বাবরী সমজিদ নিয়ে সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলেছেন এবং তারপর গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। ২০০১-এ বিএনপি-জামাত ধর্মান্ধতার খেলা খেলে এখনো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ২০০৮-এ হিন্দুরা ভোটব্যাঙ্ক হিসাবেই ভোট দিয়ে মহাজোটকে ক্ষমতায় এনেছে। ২০১৪-তে যা কিছু ভোট পড়েছে, দিয়েছে সংখ্যালঘুরা। গত দশ বছরে রামু, নন্দীরহাট, সাতক্ষীরা, অভয়নগর, লংদু, নাসিরনগর, রংপুর ও অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। কোন বিচার হয়নি।
রাজনৈতিক নেতারা এখন সংখ্যালঘু ভোটের জন্যে সুন্দর-সুন্দর কথা বলছেন। কিন্তু তাতে চিড়ে ভিজছে না? বাস্তবতা হচ্ছে, হিন্দুরা আর ‘ভোটব্যাঙ্ক’ নেই; প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিস্তর ফারাক ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরিয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনে যারা জড়িত তাঁরা যে দলের হোন, ভোট পাবেন না? সুতরাং, এদের মনোনয়ন না দেয়াই ভালো।
ওপরে যেই ভদ্রলোকের কথা বলছিলাম, তাকে চিনতাম না, তাই প্রশ্ন করি, আপনি কি করেন? বললেন, ব্যবসা। বললাম, না, জানতে চাইছি, ‘পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন’? সাবলীল উত্তর দিলেন, ‘অ্যান্টি আওয়ামী লীগ’। অবাক হইনি। কারণ, দেশে এখন দুই পক্ষ, আওয়ামী লীগ এবং অ্যান্টি আওয়ামী লীগ। বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৪’র পর বিএনপি-জামাত দৃশ্যমান নয়, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ব্যাপারে তাদের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করলেও মানুষ বিশ্বাস করেনা। গত দশ বছরের সংখ্যালঘু নির্যাতনের খতিয়ান ২০০১ থেকে খুব কম নয়? মহাজোট নেতারা এসব স্বীকার করছেন না? অথচ ক’দিন আগে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, দেশে কোথাও কোথাও সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছেন। সামনের তিন মাস ঘটনাবহুল হবে বলে সবার ধারণা। যাই ঘটুক, দেশের মানুষ যাতে শান্তিতে থাকে, কোন ঘটনার দায় যেন হিন্দুর ওপর না পড়ে? নোংরা রাজনীতি করে বা সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে অতীতে কেউ জেতেনি, সামনেও কেউ জিতবে না। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘সুশীল রাজনীতি’ এবং একটি স্ষ্ঠুু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এবারের নির্বাচনটি ২০১৪’র মত হবেনা। সবাই এতে অংশ নেবে। নির্বাচনে যেই জিতুক বা হারুক, জয়-পরাজয়ের দায়ে যেন হিন্দুর বাড়িঘরে আগুন না লাগে? নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায়না।
কলাম লেখক, নিউইয়র্ক।