স্পোর্টস রিপোর্ট : ভাঙল মিলনমেলা ভাঙল। বার্মিংহামের হাতে পতাকা তুলে দিয়ে শেষ হলো গোল্ড কোস্ট গেমসের। উদ্বোধনের মতোই জমকালো সমাপনী অনুষ্ঠান উপহার দিয়ে পর্দা নামল একুশতম কমনওয়েলথ গেমসের। কারারা স্টেডিয়ামে ৪ এপ্রিল উদ্বোধনের পর মাঠে-ময়দানে ১১ দিনের তুমুল পদক লড়াইয়ের পর যবনিকা হলো উৎসবমুখর ক্রীড়াযজ্ঞের। সমাপনীর মঞ্চও সেই কারারা। আলো-ঝলমলে গোল্ড কোস্ট গেমসের সমাপনীজুড়ে ছিল তারুণ্যের জয়গান। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশের বেশি তরুণ। এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর শোনাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আয়োজকদের কাছে। কাল রাতে তাই তরুণরাই ছিল উৎসবের প্রাণ। সমাপনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই ম্যাক্স ডেফেন্টি নামের ১২ বছরের এক কিশোরের ছোট্ট অথচ বলিষ্ঠ কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে, আবার আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। যে যেখানেই থাকুন, সবাইকে স্বাগত জানাই আজকের এই আয়োজনে। এর ঠিক পরের সম্মিলিত পরিবেশনায় কলাকুশলী ছিল গোল্ড কোস্টের ৯টি স্কুলের শিক্ষার্থী। এরপর গোল্ড কোস্টে জন্ম নেওয়া অস্ট্রেলিয়ার বিশিষ্ট শিল্পী এমি শার্কের গান মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে দর্শককে। গানের পর নাচ, একের পর এক সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় উদ্বেলিত কারারা। একপর্যায়ে ছোট-বড় নানা সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় দৃপ্তকণ্ঠে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায় ১৩ বছরের এক চটপটে কিশোর সোলি রাফায়েল। এরপর আবার শুরু হয়ে যায় সমবেত নাচ ও গানের হিল্লোল। ফাঁকে ফাঁকে বক্তব্য দেন গেমস আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা।
আগেই জানা ছিল, গোল্ড কোস্ট গেমসের সমাপনীতে সমাবেশ ঘটবে অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় সব ব্যান্ডের। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন সামান্থা জেড, থানডি ফিনিক্স, কিরা পুরু, কেট সেবেরানো, ডেবরাহ কনওয়ে, ড্যামি লিম, কোটি নুনান, এমা ডোনোভানের মতো হার্টথ্রুব শিল্পীরা। তাদের অনবদ্য পরিবেশনায় ঘুরেফিরে একটা কথাই মনে এসেছে- বিদায় সব সময় কেবল বিষাদেরই হয় না, মধুরও হতে পারেসম্প্রীতির এক অনন্য নজির স্থাপন করে এবারের দ্য ডেভিড ডিক্সন অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন পুরুষদের ১০৫ কেজি ওজন শ্রেণির ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদকজয়ী নিউজিল্যান্ডের ডেভিড লিটি। এ ইভেন্টের চূড়ান্ত পর্বে ওজন তুলতে গিয়ে আহত হন সামোয়ার প্রতিযোগী লাউইটিটি লুই। হুইলচেয়ারে বসে লুই তার জেতা রৌপ্যপদকটি গ্রহণ করেন। পদক বিতরণ মঞ্চে লিটি হাত বাড়িয়ে দেন লুইকে হুইলচেয়ারে বসানোর সময়। লিটি নিবিড় মমতায় লুইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে সান্ত্বনা জানান। অনুকরণীয় এই খেলোয়াড়ি মনোভাবের স্বীকৃতি হিসেবে সমাপনী অনুষ্ঠানে আরেকটি পদক জেতেন লিটি। ভালোবাসার ফিতায় বাঁধা সেই পদকটিরই নাম ডিক্সন অ্যাওয়ার্ড। কমনওয়েলথ গেমস ফেডারেশন বা সিজিএফের প্রয়াত মহাসচিব ডেভিড ডিক্সনের নামে ২০০২ সালের ম্যানচেস্টার গেমসে প্রথম এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। সেই থেকে প্রতিটি গেমসে একজন করে ক্রীড়াবিদ সমাপনী অনুষ্ঠানে এই স্বীকৃতি পেয়ে আসছেন।
গোল্ড কোস্ট গেমসের আয়োজকরা অনেক আগে থেকেই যে কথা বারবার বলতে চেয়েছেন, তা হলো তারা এবারের গেমসের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান যে পারস্পরিক যোগাযোগের সেতুবন্ধ রচনার মধ্য দিয়ে সবাই মিলে যেন হয়ে ওঠে একটি বৈশ্বিক পরিবার। খেলার আয়োজন শুধু খেলার মাঠে শেষ না হয়ে তা সম্প্রীতির সুর হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের আনাচে-কানাচে। সাম্যের গান গেয়ে মানবিক মূল্যবোধের দৃঢ় বন্ধনে সবাইকে বেঁধে নেওয়াই ছিল এবারের গেমসের মূল ভাবাদর্শ। তাতে গোল্ড কোস্ট কতটা সফল হয়েছে, তা সময়ই বলে দেবে। আপাতত এটুকু দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে, অতিথিপরায়ণতার অনন্য নজির হয়ে থাকবে গোল্ড কোস্ট। এবারের গেমসের মূল থিম শেয়ার দ্য ড্রিম বা স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার যে বাণী, সেটা যেন নিরন্তর সবার হৃদয়ে বয়ে গেছে নেরাং নদীর স্রোতের মতো। কাল রাতে কারারায় আতশবাজির মনোহর আলোয় ভাসিয়ে দেওয়া সমাপনী অনুষ্ঠানে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মানুষের কাছে শেষ যে বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছেন আয়োজকরা তা ছিল- একটু ভালোবাসা রাখুন আপনার হৃদয়ে।