বিশেষ প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার পর নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্য আসতে পারে, এমনটি ভাবলেও আসলে তেমনটা হয়নি। সরকার তার আগের অবস্থানেই আছে। সেই সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হয়েছে। সেখানেও অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে সরকারের ওপর নানাভাবে আন্তর্জাতিক মহল ও জাতিসংঘ চাপ তৈরি করেছে, যাতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সরকার নিজের অবস্থানে অনড় ও অটল রয়েছে। আগামী নির্বাচনও সরকারের ফর্মুলাতেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারের শীর্ষ মহল ও নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে যোগাযোগ রক্ষা করেন এমন সূত্রমতে, নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার মানে হলো কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করা। সেসব বিষয় নিশ্চিত হলে মনে করতে হবে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ হয়েছে। যেমন নির্বাচনে কোন দল অংশগ্রহণ করল কিংবা করল না তা মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হচ্ছে যেসব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, ওই সব দলের সুযোগ-সুবিধা অবাধ হচ্ছে কি না? নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছে কি না? নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না? তারা কোনো ধরনের চাপ ছাড়া নির্বাচনে ভোট দিতে পারছে কি না? সেসব নিশ্চিত করা দেখা। সরকার ও নির্বাচন কমিশন মনে করে, আগামী নির্বাচনে এসব বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে ও শর্ত পূরণ হলেই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে।
সূত্র জানায়, সরকার ও সরকারি দলের নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নীতিনির্ধারক ও আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে সম্পৃক্তরা এসব বিষয় আগামী নির্বাচনে নিশ্চিত করতে চাইছেন। এজন্য আগামী নির্বাচন সব দলের কাছে, জনগণের কাছে ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে অক্টোবর মাসের শেষ ভাগে কিংবা নভেম্বরের শুরুতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার আগেই সব দলের অংশগ্রহণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য বিভিন্ন কর্মপন্থা সবার কাছে তুলে ধরা।
সূত্র জানায়, সরকার জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মহল ও কূটনীতিকদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে। তাদের কথা একটাইÑনির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হয়েছে এটা নিশ্চিত করতে হবে। সেটা করতে হলে কী কী করতে হবে, সে রকম প্রস্তাবও তারা রাখছে ও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মনোভাব ব্যক্ত করছে। প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সরকারের একাধিক মন্ত্রী তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই সব বৈঠকের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে ও তাদের মতামত থেকে পাওয়া তথ্য থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকার আগামী নির্বাচনের জন্য কাজ করছে। সরকারের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে আগামী নির্বাচনে সংসদ বহাল রাখা। এ কারণে সংসদ সদস্যরা বহাল থেকেই নির্বাচনে অংশ নেবেন। তাদের পদত্যাগ করতে হবে না। যদিও তারা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নিষ্ক্রিয় থাকবেন। তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য নিজ নিজ এলাকায় যাবেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা সংসদ সদস্য হিসেবে যেধরণের সুযোগ-সুবিধা পান, তা নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। ভারত ও ইংল্যান্ডে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। সেখানে এমপিরা বহাল থেকেই নির্বাচনে অংশ নেন। তবে তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা নেন না। তারা নিষ্ক্রিয় থাকেন। আগামীতে বাংলাদেশেও একই রীতি চালু করা হচ্ছে। ফলে এমপিরা পদে থাকলেও কোনো কিছু করতে পারবেন না। তারা সরকারি রুটিনকাজও করতে পারবেন না। জেলায় ও নিজ এলাকায় যেসব কমিটির সঙ্গে তিনি যুক্ত আছেন, সেসব কমিটিতেও কাজ করতে পারবেন না। এর মধ্যে রয়েছে জেলা প্রশাসকের কমিটি, ত্রাণ কমিটি। সব কমিটিতে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের কোনো ক্ষমতা থাকবে না।
এর পাশাপাশি সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী থাকবেন তারা ওই সময়ের সরকারের কোনো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তারা নির্দলীয় সরকার যে রকম রুটিনকাজ করে, সেই কাজগুলো করবেন। সরকারের মন্ত্রীরা নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি মন্ত্রী হিসেবে এলাকায় গেলে ও প্রার্থী হলে প্রচারণা চালাতে পারবেন কিন্তু কোনো সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন না। তিনি এলাকায় গিয়ে কোথাও কোনো ধরনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবেন না, উন্নয়নমূলক কোনো কর্মকা-ও করতে পারবেন না। এগুলো করলে এলাকায় ভোটারদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে মনে করে তারা এসব কাজ থেকে বিরত থাকবেন। কোনো মন্ত্রী নিজের নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণার কাজে গেলে কিংবা কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে গেলে তিনি কোনোভাবেই সরকারি ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিতে পারবেন না। এই বিষয়গুলো সরকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। তবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান ও নির্বাচনে অংশ নিলেও তিনি রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিতে পারবেন না, এমন কোনো বিধান এখনো করার ব্যাপারে কোনো চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে না। কারণ প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি বড় করে দেখা হচ্ছে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ও নির্বাচনে প্রার্থী হলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার। যদিও বিএনপি এটা মেনে নেবে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান ও আওয়ামী লীগের প্রধান হওয়ার কারণে তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় কেবল সভা-সমাবেশ করবেন, বিষয়টি এমন নয়। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা ছাড়াও অন্যান্য এলাকায় প্রয়োজনীয় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন। তিনি ৬৪টি জেলায় সভা-সমাবেশ করবেন না। তিনি পাঁচটি কিংবা এর কিছু বেশিসংখ্যক এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন। তবে তার অংশ নেওয়া পাঁচটি নির্বাচনী এলাকায় নাকি এর বাইরেও তিনি অন্যান্য এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেবেন, সেটা পরে ঠিক করা হবে। যদিও এখনো পর্যন্ত বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে কোনো রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন না। তিনি প্রশাসনের ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এই সময়ে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করবে নির্বাচন কমিশন। ওই সময়ের বেশির ভাগ প্রশাসনিক দায়িত্ব থাকবে নির্বাচন কমিশনের ওপর। প্রশাসনে রদবদল করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আগেই করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারের ও প্রশাসনের কোনো স্তরে নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্নকরণ, বদলি, ওএসডি কিংবা অন্য কোনো ধরনের কাজ নির্বাচন কমিশনের সুপারিশ ছাড়া করতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে কেবল জরুরি প্রয়োজনে বদলি করা যাবে।
আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বড় একটি শর্ত হচ্ছে বিদেশিদের। তা হলো নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলের ইচ্ছা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হবে। এ জন্য দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। যদিও সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে, আগামী নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা যাতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিদেশি পর্যবেক্ষককে সুযোগ দেওয়া। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারেও সরকার থেকে কমিশনকে বলা হয়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধনের জন্য সুযোগ দিতেও বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা কী চায় ও তারা কেমন করে এটা করতে চায়, সেভাবেই তাদের সুযোগ দিতে হবে।
বিএনপির সূত্র জানিয়েছে, সরকার তাদের পরিকল্পনামাফিক নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার, তারা সবই করবে। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া হবে না। আমাদের ৭ দফা দাবি মেনেই সরকারকে নির্দলীয় সরকার গঠন করে ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করেই কাজ করতে হবে। বিএনপি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না হলে নির্বাচনে যাবে না। আর বিএনপিকে ও ২০ দলীয় জোটকে বাদ দিয়ে সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার যত চেষ্টাই করুক, যত উদ্যোগই নিক না কেন, তা সফল হবে না।