বিশেষ প্রতিনিধি : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহাকে হত্যা বা চাকরিরত নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিমকে আহত করার মধ্যেই ঘটনা ঘুরছে না। এর আগে-পিছে আরো অনুষঙ্গ রয়েছে। এ ধাঁচের ঘটনা এবারই প্রথম নয়, আবার শেষও নয়। সরকারের ক্ষমতার ইনডোরে ঘটে চলা এ ধরনের ঘটনার কিছু কিছু প্রকাশ পেলেও ধামাচাপা থেকে যাচ্ছে অনেক বেশি। সেগুলো দক্ষ হাতে সামলেও নেওয়া হচ্ছে। এবারও হয়ে যাবে বলে নিশ্চিত সরকারের শীর্ষ মহল। এর অনেকটা এরই মধ্যে হয়েও গেছে। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত।
এভাবে চলতে থাকলে দল, সরকার, এমনকি নিজের অস্তিত্বের জন্য চরম ঝুঁকি দেখছেন তিনি। তাই তার অ্যাকশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত প্রায়।
এ ধরনের ঘটনার একটিও আদর্শিক বা নৈতিক নয়। প্রায় প্রতিটিই নিজস্ব স্বার্থসংশ্লিষ্ট। পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের গন্ডগোল বাধছে। এর পেছনে মন্ত্রী-এমপিসহ জনপ্রতিনিধি এবং প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ পরিবার বা ঘরানার সম্পৃক্ততা। বেশির ভাগই সুযোগ-সুবিধার ভাগযোগ-সংক্রান্ত। পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে নিত্য এসব গোলমাল একপর্যায়ে মিলমিশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্ষত সারছে না। বাড়তে বাড়তে এই ভাগযোগের শরিকানা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কোনো কোনো পর্যায়েও গড়াচ্ছে। সরকারি বিশাল অঙ্কের কেনাকাটা, বড় বড় টেন্ডার, তদবিরের দৌড়ঝাঁপ অবিশ্বাস্য পর্যায়ে। প্রতিটি ব্যক্তি এবং জায়গায়ই ক্ষমতার শরিক। সরকারকে বিরতিহীনভাবে ক্ষমতায় আনা, ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা, সরকারের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে তাদের ব্যাপক অবদান। কেউই ফেলনা নন। উপরন্তু কার বেশি অবদানÑএ নিয়ে বড়াই রয়েছে। সেই দৃষ্টে পাওনাও বুঝে নিচ্ছেন তারা। পাওনার ভাগাভাগিতে হেরফের হলে বাধছে গোলমাল।
আদর্শিক না হওয়ায় গোলমালটা বেশি দূর গড়ায় না। অথবা উপর মহলের ধমকে চুপসে যায় ভাগাভাগির পক্ষগুলো। দিনে দিনে সেটা এখন আর নিয়ন্ত্রণ মানছে না। কে নেতা, আমলা, পুলিশ; কে সেনা, নৌ বা বিমানের লোক-এর বালাই থাকছে না। কাউকে মারতে, সাইজ করতে এমনকি গায়ে হাত তুলতেও বাধছে না। জানে মেরে ফেললেও কিছু হবে না-এমন একটি কনফিডেন্স সবারই। যুক্তি এবং ক্রিয়াকর্মে তারা সবাই একই গোত্র বা ঘরানার। তাদের মধ্যে সুযোগ কে বেশি হাতাচ্ছে, তা নিয়ে স্নায়ুদ্বন্দ্ব এত দিন উপর মহলের ধমকে থামিয়ে দেওয়া গেলেও সম্প্রতি আগের মতো পারা যাচ্ছে না। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নানা জায়গায়। সচেতন এবং সতর্করা এ নিয়ে ভাবনায় না গিয়ে নীরব দর্শক। সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা থাকলেও নির্লিপ্ত ভাব। করোনায় নেতা, এমপি, মন্ত্রী মারা গেলে গা মাখে না। কোনো বাহিনীর সদস্য মার খেলেও ঘটনা মনে করে না। এ ধরনের কিছু ঘটনা এবং ভিআইপি মৃত্যু পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের চরম মন্তব্য কম্পাইল করা একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট সরকারের শীর্ষ মহলে পৌঁছেছে। মৃত্যুতেও আনন্দ প্রকাশের এমন বিকৃত মন্তব্য ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য।
সংবাদপত্র বা টিভি মিডিয়ায় এসব খবর না এলেও সব খবর গোপন থাকছে না। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু কিছু প্রকাশ পাচ্ছে। ঢাকার হাজী সেলিমের মতো সারা দেশে এ ধরনের কিছু পরিবারের কাণ্ডকীর্তির রোমহর্ষক কিছু তথ্য-প্রমাণ পৌঁছেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ছোট-বড় মিলিয়ে এ সংখ্যা অগুনতি। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে পিটিয়ে জেলে যাওয়া ইরফান সেলিমের বাবা-শ্বশুর এমপি। শাশুড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান। বাসা-বাড়ি, অফিসে টর্চার সেল, গোটা এলাকায় সিসি ক্যামেরা, ওয়াকিটকি বাহিনী এমন অনেকেরই। বাপ-বেটা, জামাই-শ্বশুর মিলে চাঁদাবাজি, ইয়াবা ব্যবসা, মানব, নারী, অর্থ পাচার হেন কাজ নেই, যা তারা না করছেন। পুলিশসহ নানা সংস্থার লোকজনও তাদের সুহৃদ। পার্টনারও। এর জেরে মাঝেমধ্যে গোলমাল। বিব্রতকর অবস্থা হচ্ছে সরকারের। দক্ষ হাতে সরকার সেটা সামলাতে না সামলাতেই ঘটছে আরেকটা। ধারাবাহিকভাবে তা মাত্রা ছাড়ানো পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
মাস কয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কিছু ব্যক্তিকে ধরার পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার পাওয়ার বক্সে আঘাত করলে হিতে বিপরীত হতে পারেÑএই জুজুতে থামানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে ইউটার্ন দিতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ থেকে দুর্নীতিপরায়ণ গণপরিষদ সদস্য এবং পরিবারকে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছিলেন তিনি। এই অভিযানের প্রথম দফায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও গণস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে দল থেকে ১৯ এমসিএকে বহিষ্কার করার কথা ঘোষণা করা হয়। বহিষ্কৃত গণপরিষদ সদস্যরা হলেন ঢাকা জেলার আব্দুল হাকিম মাস্টার, মাজেদ আলি মুক্তার, রংপুরের আবু সুলাইমান মণ্ডল, জাহিদুর রহমান, তাহেরুল ইসলাম খান, রাজশাহীর রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ও আব্দুস সালাম, পাবনার কে বি এম আবু হেনা, কুষ্টিয়ার জহুরুল হক, যশোরের মোশাররফ হোসেন, খুলনার হাবিবুর রহমান খান, ফরিদপুরের কাজী হেদায়েত হোসেন, সিলেটের মাসুদ আহমদ চৌধুরী, কাজী সিরাজ উদ্দিন আহমদ, কুমিল্লার গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ ও মোহাম্মদ হাশেম, নোয়াখালীর সাখাওয়াত উল্লাহ, চট্টগ্রামের মির্জা আবু মনসুর ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী। ধর্ষকবিরোধী অ্যাকশনও চলেছিল কয়েক দিন। চুয়াত্তরে ঢাকার পাশে এক নেতাকে ধরা হয়েছিল ধর্ষণ করে সেই নববধূকে হত্যার অভিযোগে। তাকে গ্রেফতারকারী মেজর নাসেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে সেদিন উল্লাস করেছিলেন ওই নেতার কর্মী-সমর্থকেরা। সেই নেতা পরে মন্ত্রী হন। এখনো আছেন দাপটে। আজকের বাস্তবতায় সে ধরনের অভিযান বা অ্যাকশন ফল দেবে, না বুমেরাং হয়ে ক্ষতি ডেকে আনবেÑসেই দুশ্চিন্তা ও গবেষণা রয়েছে সরকারের অভ্যন্তরে।
সরকারের পাওয়ার বক্সে শীতল বিস্ফোরণ
অস্তিত্বে ননস্টপ আঘাত : চরম অ্যাকশনের পথে প্রধানমন্ত্রী