সরাসরি ক্ষমতা চায় না বিএনপি

নূরুল ইসলাম : দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবার মাঠে থাকতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদলে অন্য সরকার চায়। তবে বিএনপি সরাসরি ক্ষমতা চায় না। অন্য শক্তির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে তবেই ক্ষমতার চেয়ারে বসতে চায়। এ জন্য নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিকদের প্রতি দৃষ্টি রেখেছে। তারা কিছু সময় দেশের সংস্কার করলে এরপর ক্ষমতার স্বাদ নিলে বিএনপির নেতৃত্ব দীর্ঘায়িত হবে মনে করা হচ্ছে। বিএনপি সরাসরি ক্ষমতায় এলে দেশে একটি অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
সূত্রমতে, দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশের মৌলিক মেরুদণ্ডগুলো ভেঙে ফেলছে। ব্যাংক-ব্যবস্থা, শেয়ারবাজার লুট, মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে দুর্নীতি করে দেশের অবস্থা তলানিতে নিয়ে এসেছে। বিচারব্যবস্থা, দেশের আইনশৃঙ্খলাও বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই দেশ পরিচালনার জন্য একটি অবকাঠামো দরকার। দেশের বিশেষ ব্যক্তিদের মাধ্যমে সংস্কারের জন্য বিএনপির ঘরে বড় পরামর্শ এসেছে। দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোও বিএনপিকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে, যাতে বিএনপির ছায়ায় অন্যের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা হয়, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। রক্তপাতহীনভাবে ক্ষমতায় এলে বিএনপি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বচ্ছতা পাবে।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, এখন যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামানোই তাদের মূল টার্গেট। প্রয়োজনে দুই বছর অন্য কাউকে ক্ষমতা দিতেও রাজি হয়েছে। সেই আলোকে জাতীয় সরকার গঠন, যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলছে। শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে গ্রহণ করবে যেকোনো উপায়ে। তবে শেখ হাসিনার বদলে কে হবেন সরকারপ্রধান- এ নিয়ে বিএনপি কিছু নাম ঠিক করে রাখলেও প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করবে। লন্ডনে অবস্থানরত দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বার্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করে যাচ্ছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির মাঠে নামার বিষয়টি তৃণমূল নেতারা ভালোভাবে নিয়েছেন। সব ডাকেই রাজপথে নেমে আসছেন তারা।
রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য স্থানে সমাবেশগুলোতেও নেতাকর্মীদের উপস্থিতি চোখের পড়ার মতো। হামলা-মামালায়ও আর কেউ ভয় পাচ্ছেন না। গত দুই মাসে বিএনপির সাত নেতা পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন, রাজধানীসহ বহু জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে, তবুও পিছু হটছেন না নেতাকর্মীরা। এভাবে ভোট পর্যন্ত সিরিজ কর্মসূচি চলতে থাকবে।
সর্বশেষ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসেছে নতুন সিদ্ধান্তÑবিভাগীয় শহরের গণসমাবেশ শেষ করে রাজধানীতে আগামী ১০ ডিসেম্বর মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। মহাসমাবেশের আগেই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায় তারা। প্রথমত, বিএনপি থেকে নির্বাচিতদের জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ, যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করা এবং নির্দলীয় সরকারের এক রূপকল্প তৈরি করে জাতির সামনে তুলে ধরা। যদিও এ নিয়ে বিএনপির একাংশের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
একাদশ নির্বাচনের আগে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান নেতা মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে বিএনপি। ওই নির্বাচনে দলটির রাজনৈতিক ইতিহাসে ন্যক্কারজনক ভরাডুবি হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোটের অভিযোগ তুলে সকালে বেশির ভাগ প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলেও দুপুরেও দলটির মহাসচিব জয়ের স্বপ্নের কথা জানান! বেলা শেষে মাত্র সাতটি আসন ভাগ্যে জোটে। আবার নানা নাটকীয়তায় বিজয়ী ব্যক্তিদের সংসদেও পাঠানো হয়। তবে মির্জা ফখরুল রহস্যজনকভাবে দূরে ছিলেন। এ ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেও দলটি জনগণের নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়ে।
এদিকে এখনো আওয়াজ তোলা হচ্ছে- বিএনপি আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যাবে না, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। বিএনপিকে পরামর্শ দেওয়া বুদ্ধিজীবী মহল বলছে, আওয়ামী লীগ নিজেও ২১ বছরে বিভিন্ন রকমের বেকায়দা মোকাবিলা করেছে। এই বেকায়দা মোকাবিলা করতে করতে আজকে একটি অবস্থানে গিয়ে পৌঁছেছে। ক্ষমতায় আসতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু সামরিক শাসনসহ বিভিন্ন সময়ে নানান কৌশলে এগিয়েছে, ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেছে। আজকের বিএনপিও আওয়ামী লীগের মতো নানান সংকটে রয়েছে। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে, দলের চেয়ারপারসন শর্তে মুক্ত। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তারেক রহমান নেই দেশের মাটিতে। দলের শীর্ষ নেতারাও কেউ কারাগারে, কেউ দেশছাড়া। এ পরিস্থিতিতেও বিএনপিকে ভোটে যাওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি রাখা উচিত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই নির্বাচন বর্জন করে। তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় ওই নির্বাচন নিয়ে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ হয় প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে গিয়েও বিএনপির ভরাডুবি হয়। ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ মহাজোট পায় ২৮০টি আসন। ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন আর অন্যান্য দল পায় ১১টি আসন। তবে বিএনপি যদি আগে থেকেই চূড়ান্ত কৌশল ঠিক করতে পারত, খালেদা জিয়ার বার্তা ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারত, তাহলে এ পরিস্থিতি হতো না।
এসব বিষয়ে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারকে আর ছাড় দেওয়া হবে না। আমাদের জনপ্রিয় নেতা তারেক রহমান শিগগিরই দেশে আসবেন। খালেদা জিয়াকে নির্যাতন ও সব ষড়যন্ত্রের বিচার হবে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আবারো দেশ পরিচালিত হবে। রাষ্ট্র নেতৃত্বের বিষয়গুলো আমাদের দেশের নাগরিকেরাই ঠিক করবেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই, মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। ইতিমধ্যে আমাদের সাতজন প্রাণ দিয়েছেন। আমরা হাজারো প্রাণ দেব, তবু এই সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করব। আমি কয়েকটি মিটিংয়ে বলেছি, সেফ এক্সিট করেন, চলে যান, ক্ষমতা ছাড়েন। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেন, সংসদ বিলুপ্ত করেন। নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে নতুন পার্লামেন্ট ইলেকশন দেন। তারা নতুন করে সরকার গঠন করবে, দেশে নতুন একটি সরকারব্যবস্থা চালু হবে।’