সাইডলাইন আতঙ্কে বিএনপি

দর্শকরাও খেলোয়াড় : ধ্রুপদি ফাঁদে সরকার

বিশেষ প্রতিনিধি : কোয়ার্টারে জয়ী দাবি করার পরও বিএনপির সঙ্গে সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলার সাহিত্যভরা হুইসেল বাজিয়ে প্রশ্নের সমান্তরালে রহস্যও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। কোয়ার্টারে পরাজিতের সঙ্গেই কীভাবে সেমিফাইনাল-ফাইনাল? যেনতেন খেলার বাইরের এ খেলায় গ্যালারির দর্শকেরাও মাঠে নেমে পড়তে শুরু করেছে। বহু দর্শক কাম খেলোয়াড় সেখানে। তার ওপর ঢাকার বিদেশি দূতদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে গালমন্দসহ কড়া বার্তা দিয়ে খেলোয়াড়ের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিদেশিদের বাংলায় দেওয়া গালাগালগুলোর ভাবানুবাদ নয়, হুবহু ইংরেজি অনুবাদ এখন ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের পকেটে পকেটে। মার্কিন দূতাবাসের একটা বিশেষ সেল রয়েছে। তাদের মূল কাজ এ ধরনের বক্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাদের দেশ ও দূতাবাসের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা। এ কাজটি এবার বেশি দ্রুত হয়ে গেছে। যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ডেস্কেও চলে গেছে। সাপ্লিমেন্টারি হিসেবে রয়েছে দুই আনার মন্ত্রী, কাজের মেয়ে মর্জিনার হার্ড-সফট কপিও।
দেশি-বিদেশি আরো কিছু কারণে ‘খেলা’ কোন দিকে গড়াবে, সেই নমুনা দেখে আরো বহু দর্শকেরই খেলোয়াড় হয়ে মাঠে নেমে পড়ার একটি বাতাবরণের অপেক্ষা। আন্দোলনরত বিরোধী দলের সেখানে সাইডলাইনে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হতে পারে। বিএনপিকে সাইডলাইনে ফেলে অন্য কারো এ খেলায় জিতে যাওয়ার গ্যারান্টি থাকলে তাতে সায় আছে সরকারেরও।
এ কারণে সময়টা বিএনপির জন্য আশীর্বাদের পাশাপাশি আতঙ্কেরও। পা ফেলতে হচ্ছে খুব সাবধানে। সরকার ‘হটাতে’ তাদের ১০ দফার সঙ্গে রব-মান্নাদের সাত দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা, জামায়াতের যুগপতের নতুন ফর্মুলা, কর্নেল (অব.) অলিসহ পুরোনো মিত্রদের বিএনপির অফিসে ছুটে যাওয়ার মধ্যেও দলটিকে সাবধানতা রক্ষা করতে হচ্ছে দমে দমে। জামায়াতে ইসলামীর দফাও ১০। এসব দাবির ভিত্তিতে ২৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে গণমিছিলের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও কাউন্সিল। সরকার ও দল থেকে বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, সেদিন বিএনপি বা তার মিত্রদের কাউকে কোনো কর্মসূচি না রাখতে।
রাজনীতির গ্যালারির আরেক দর্শক হেফাজতে ইসলাম। তারা নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও আদতে রাজনীতির ঘটক-অনুঘটক বিশাল এই জনগোষ্ঠীটি। শাপলা চত্বরে ধোলাই খাওয়ার পর থেকে তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মাঝেমধ্যে মোচড় দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের কত লোক শহীদ হয়েছে, একদিন এর মাশুল আদায়ের হুংকার ছাড়ে। সরকারের থেরাপিতে পরে আবার চুপসে যায়। হাজার-শত নয়, সেই রাতে তাদের কেউ শহীদই হয়নি, তেমন কিছু ঘটেইনি বলে স্বীকারোক্তি পর্যন্ত দেয়। ক্ষোভে-লাজে হেফাজতের একটি গ্রুপ এতে বিষ খেয়ে বিষ হজম করে। ফোঁসফাঁস করে। এরা সম্প্রতি আবার চটেছে হেফাজতকে উদ্ধৃত করে দেওয়া সরকারি মহলের কিছু মন্তব্যে। বিশেষ করে, বিএনপিকে নয়াপল্টনে শাপলা চত্বরে হেফাজতের দশা করে ছাড়ার হুমকিটি হেফাজত নেতাদের ভীষণ মনঃকষ্ট দিয়েছে। যেখানে সরকারের দাবি, ‘ওই রাতে হেফাজতের সমাবেশে ক্র্যাকডাউনে কিছুই করা হয়নি, হতাহতের ঘটনাও মিথ্যা’, হেফাজত নেতাদের দিয়েও তা বলিয়ে ছাড়ানো হয়েছে; এখন সরকারই তা আবার উসকে দিয়েছে। এর জেরে হেফাজতের কয়েক নেতা গ্যালারি থেকে খেলার মাঠে নামার অ্যাজেন্ডায় ব্যস্ত। বিএনপির সঙ্গে পুরোনো খায়খাতির ঝালাই করে এগোচ্ছেন। জামায়াতের সঙ্গেও মোলাকাত করেছেন। এর অনুঘটক জামায়াতের আমির ডা. শফিক। তা নিশ্চিত হওয়ার পর আর দেরি করেনি সরকার। উত্তরার বাসা থেকে তাকে তুলে এনে ঘণ্টা কয়েক নানান জায়গায় ঘুরিয়ে পরে গ্রেফতার দেখিয়েছে।
দর্শক কাতারের খেলোয়াড় আরো আছে। দর্শকেরা খেলতে নেমে গেলে কারো বিপদ আরো বাড়ে। কেউ হয়ে যায় বেনিফিশিয়ারি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, মানবাধিকার কর্মী শারমীন মুরশিদ, শিরিন হক, নূর খান লিটন, অ্যাডভোকেট সালমা আলী, গবেষক ড. বীনা ডি কস্টাসহ বিশিষ্ট কয়েকজনের মাঠে নামার তথ্যও জেনেছে সরকার। রোজিনাসহ কয়েক সাংবাদিক ও সম্পাদকও অবিশ্বাস্যভাবে যুক্ত তাদের সঙ্গে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদেরকে হুমকি দেওয়ার রহস্য এখানেই।
সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে মৃত বলে বিবেচিত বিএনপি কীভাবে এত গণসমর্থন জোগাড় করছে, তা সরকারের জন্য আতঙ্কের। সরকারের সহযোগীদের পরামর্শ শেখ হাসিনাকে আরো আগ্রাসী ও শক্তিমত্তার জানান দেওয়া। এত দিনের মতো এর ধারাবাহিক সুফল পাওয়ার বল-ভরসা দেওয়া হচ্ছে তাকে। এটি ধ্রুপদি ফাঁদ, নাকি তাকে ডোবানোর আয়োজন-এ নিয়ে অন্তহীন ভাবনা কাজ করছে তার হিতাকাক্সক্ষী মহলে। দলের সাতজন এমপিকে নিমেষে সংসদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে ফেলানোর পেছনে দলের মেরুকরণকারী নির্বাসিত নেতা তারেক রহমানের কিছু ক্রিয়াকর্ম তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বিএনপি কোনোভাবে ক্ষমতায় এসে পড়লে আওয়ামী লীগের কী পরিণতি হতে পারে, সেই ভাবনাও কাজ করছে।
সরকার নিজেকে কিছুটা নির্ভার ভাবতে শুরু করেছিল ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের ফাঁড়া কেটে যাওয়ায়। আটকের আগের দিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলে গেছেন, ১০ তারিখ শনিবার এমন কিছু ঘটবে, যা অনেকের কল্পনাতীত। তার ওই বার্তা একেবারে ফলেনি, তা ভাবছে না সরকারের ভেতরের একটি অংশ। বিশেষ করে, গোলাপবাগের সমাবেশে বিএনপির সাত এমপির সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা। এ সংক্রান্ত আগাম ধারণা ছিল না অনেকেরই। তা সরকারকে মারাত্মক আহত করেছে। কারণ, বিএনপির এই সাত এমপিকে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সূক্ষ্ম খেলা ভণ্ডুল হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে র‍্যাবের কয়েক কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন আরোপের বার্ষিকীও ছিল ১০ ডিসেম্বর ২০২১, শনিবার। যুক্তরাষ্ট্র এবার ৯ দেশের ৪০ ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও বাংলাদেশের কারো নাম না থাকায় স্বস্তি পায় সরকার। এবারও স্যাংশনের গুঞ্জন ভাসছিল। বাংলাদেশের ওপর আবারও স্যাংশন জারি হলে তা ন্যায্য হবে না বলে আগেই মন্তব্য করে বসেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। নতুন স্যাংশনের ভয় কেটে গেলেও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানানো অব্যাহত রেখেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। যুক্তরাষ্ট্র লেগেই আছে। সঙ্গে যুক্তরাজ্যসহ আরো অন্তত ১৪ দেশ। কেবল ইশারা-ইঙ্গিত নয়, প্রকাশ্যে যৌথ বিবৃতি পর্যন্ত দিয়েছে তারা। বিরোধী দলকে দমন এবং মানবাধিকারের কথাটি আসছেই ঘুরেফিরে। রাস্তাঘাট আটকে জনদুর্ভোগ তৈরি, পুলিশ দিয়ে নয়াপল্টনসহ আশপাশ অবরুদ্ধ রেখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি ‘নোট’ হয়ে গেছে। পুলিশের সঙ্গে দলীয় কর্মীদের নামিয়ে সমাবেশে বাধা, মানুষকে তল্লাশির নামে হয়রানি, পথচারীদের আটকে তাদের মোবাইলের কল লিস্ট, চ্যাটিং, গ্যালারি চেক করা মানবাধিকারের চরম খেলাপ হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছে।